ছাত্র আন্দোলনের শুরুর মহিমা
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের রাজপথে এক নতুন ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার, নিয়োগে বৈষম্য, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘Students Against Discrimination’ (SAD) নামের একটি ছাত্র সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার রাজপথ, শহরের মোড়, জেলা সদর ও গ্রামের মাঠ—সব জায়গায় ছাত্রদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়: “আমরা বৈষম্য চাই না”, “আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই।” আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রনেতারা তখন জনগণের চোখে হয়ে ওঠেন মুক্তির দূত, পরিবর্তনের প্রতীক। তাদের অনেকে একাডেমিকভাবে মেধাবী, সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়ায় সমাজ তাদের ‘জেনিয়াস’ বলে অভিহিত করতে শুরু করে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সাধারণ নাগরিকদের একাংশ মনে করেছিল, এরা বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপকার হবে।
হঠাৎ রূপান্তর: প্রশংসা থেকে ঘৃণায়
কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই ‘জেনিয়াস’ ছাত্রনেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, জমি দখল, ঠিকাদারিতে হস্তক্ষেপ, এমনকি ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। SAD-এর বিভিন্ন জেলা ও মহানগর কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক ও ঠিকাদাররা সরাসরি অভিযোগ করতে শুরু করেন যে, SAD-এর পরিচয় ব্যবহার করে তারা অর্থ দাবি করছে এবং তা না দিলে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা আন্দোলনের নামে হুমকি দিচ্ছে। একাধিক ঘটনায় ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তারও করা হয়। কিছু এলাকায় তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রশাসনকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠে। আন্দোলনের যে নৈতিক উচ্চতা একসময় জনগণকে আকর্ষণ করেছিল, সেই জায়গাটি দ্রুত রূপ নেয় অনাস্থা ও বিতৃষ্ণায়।
কেন এমন রূপান্তর ঘটল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ছাত্রনেতাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকাতে হয়। SAD-এর নেতৃত্বে থাকা অনেকেই এসেছে নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের শৈশব কেটেছে চরম অভাব-অনটন, খাদ্য সংকট, পুরাতন জামাকাপড়ে, টিউশনির অর্থে পড়াশোনা চালিয়ে। এমন কঠিন বাস্তবতা থেকে উঠে আসা এই তরুণরা যখন হঠাৎ রাজনৈতিক প্রভাব ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়, তখন তাদের অনেকেই সেই অবস্থানকে ধরে রাখার পরিবর্তে দ্রুত লাভের পথে পা বাড়ায়। এক ধরনের ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রতিশোধমূলক মানসিকতা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে কেউ কেউ নিজেকে ক্ষমতাধর ভাবতে শুরু করে এবং সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। সহজভাবে বললে, তারা নেতৃত্বের আদর্শিক অবস্থান ভুলে গিয়ে ক্ষমতার মোহে পড়েছেন।
সংগঠন ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা
SAD-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হয়তো নৈতিক জায়গা থেকে সংগঠন গড়েছিলেন, কিন্তু দ্রুত সম্প্রসারণ, স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের ঘাটতির কারণে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে সংগঠনের নামে অনেকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার শুরু করে। SAD-এর বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে কোনো যাচাই-বাছাই বা কার্যকর মনিটরিং ছিল না। ফলে সংগঠনের নাম ও লোগো ব্যবহার করে কেউ কেউ ঠিকাদারিতে দালালি, ভূমি দখল কিংবা নানাবিধ চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। সংগঠনটির ভিতরে বিরুদ্ধ মত দমন, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনও এই সংকটের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিরবতা এবং দায়িত্বহীনতা প্রশ্ন তুলেছে তাদের অবস্থান ও উদ্দেশ্য নিয়েও।
রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ ও বিকৃতি
আরও একটি বড় কারণ হলো, SAD-এর মতো অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের কর্মী ও অনুসারীদের ঢুকিয়ে দেয় সংগঠনের ভেতরে। এসব লোক SAD-এর নাম ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন, প্রভাব বিস্তার এবং প্রশাসনিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এমন অনুপ্রবেশ নতুন নয়—নব্বইয়ের দশকের পরেও দেখা গেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ছাত্রনেতারা কিভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন ও ক্যাম্পাস দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। SAD-এর ভেতরেও সেই পুরনো সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা জনগণের বিশ্বাসকে চূর্ণ করছে।
নেতৃত্বের সামাজিক পটভূমি ও মনস্তত্ত্ব
এই রূপান্তরের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিকও রয়েছে। দীর্ঘদিন বঞ্চনার মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্ম, যাদের শৈশব কেটেছে টিকে থাকার লড়াইয়ে, যখন হঠাৎ কিছু ক্ষমতা, জনসমর্থন ও মিডিয়ার আলোয় আসে, তখন তারা অনেক সময় নিজেকে ‘সিস্টেম’-এর ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। তারা বিশ্বাস করে—এখন সমাজ তাদের কাছে ঋণী। সেই ঋণ তারা অর্থ, প্রভাব ও সুবিধা নিয়ে ‘উসুল’ করতে চায়। এই মনোভাবই ধীরে ধীরে তাদের বিপথে ঠেলে দেয়। নীতি, আদর্শ, সংযম—এসব তখন মুখস্ত বুলি হয়ে যায়। ফলে সমাজের চোখে তারাই হয়ে ওঠে সেই ‘চাঁদাবাজ ছাত্রনেতা’, যাদের একসময় মানুষ নায়ক ভাবত।
বিশ্বাসের পতন ও ভবিষ্যতের শিক্ষা
একটি মুক্তির আন্দোলন, যার প্রতি দেশের কোটি মানুষের আশা ছিল, তা মাত্র এক বছরের ব্যবধানে যখন অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ভবিষ্যতের। SAD-এর ঘটনাপ্রবাহ আমাদের শিখিয়েছে—নেতৃত্ব শুধু ভাষণ ও সাহসে তৈরি হয় না; এটি তৈরি হয় নৈতিকতার ভিত, সংগঠনের স্বচ্ছ কাঠামো ও নেতৃত্বের দায়বদ্ধতায়। এই রূপান্তর আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—সমাজের দরিদ্র, বঞ্চিত অংশ থেকে উঠে আসা নেতারাও ক্ষমতা পেলেই দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটে, তাহলে কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া শুধুমাত্র আন্দোলন সমাজকে বদলাতে পারে না।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু SAD-এর অভিজ্ঞতা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সতর্কবার্তা—প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও স্বচ্ছতা না থাকলে, নেতৃত্ব শুধু ধ্বংসই ডেকে আনতে পারে। ভবিষ্যতের নেতাদের জন্য এটি একটি অনিবার্য শিক্ষা।