এক রহস্যময় দর্শনার্থীর সন্ধানে
বাংলাদেশের বনভূমিতে এমন এক প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে, যার উপস্থিতি এতটাই দুর্লভ যে, একে বলা হয় “ছায়া শিকারি”।
এই প্রাণীটি হলো মার্বেল বিড়াল (Marbled Cat, বৈজ্ঞানিক নাম: Pardofelis marmorata)। এরা এতটাই দুর্লভ যে বিগত এক দশকে হাতে গোনা মাত্র কয়েকবারই ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়েছে। এই বিড়াল বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে যেমন এক রহস্যময় উপাদান, তেমনি বিশ্বব্যাপীও এক বিস্ময়ের নাম।
প্রথম আবিষ্কার: এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত
২০১৪ সালে চট্টগ্রামের হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রথমবারের মতো মার্বেল বিড়ালের ছবি ধরা পড়ে ক্যামেরা ট্র্যাপে। তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই প্রজাতিটি বাংলাদেশের বনে টিকে আছে।
এরপর ২০২০ ও ২০২২ সালে আরও দু’বার এই বিড়াল ক্যামেরায় ধরা পড়ে, কিন্তু আজও সরাসরি মানুষের চোখে এই প্রাণীর দেখা পাওয়া বিরল ঘটনা।
চেহারা ও বৈশিষ্ট্য: সৌন্দর্য আর ছায়ার মিশেল
মার্বেল বিড়ালের গায়ে থাকে মার্বেল পাথরের মতো মিশ্র ছোপ ছোপ নকশা, যেখান থেকে এদের নামের উৎপত্তি। গায়ের রং বাদামি, তাতে কালো ও ধূসর ডোরা ও ছাপা দাগ। চোখ বড়, লেজ লম্বা এবং দেহ অত্যন্ত নমনীয়।
তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো—এরা গাছে চড়তে অত্যন্ত দক্ষ। এমনকি মাথা নিচে করে গাছে চলাফেরা করতেও সক্ষম, যা বিড়াল প্রজাতির মধ্যে এক বিরল বৈশিষ্ট্য।
বাসস্থান: গহিন পাহাড়ি বনাঞ্চলে নিঃশব্দ বিচরণ
মার্বেল বিড়াল বাস করে মূলত গভীর চিরসবুজ বনাঞ্চল ও উঁচু পাহাড়ি গাছপালার ছায়ায়। চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চলে এদের উপস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বন ধ্বংস, জুম চাষ, বনাঞ্চলে রাস্তা কাটা ইত্যাদি কারণে এদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস: গাছে-বাসা এক নিঃশব্দ শিকারি
এই বিড়াল রাতে সক্রিয়, এবং সাধারণত গাছে গাছে চলাফেরা করে।
তাদের খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে—
- গাছের পাখি ও তাদের ডিম
- গাছের ফাঁকে বাস করা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী
- গিরগিটি, কাঠবিড়ালি
- মাঝে মাঝে ছোট বানরও
তবে এদের আচরণ এখনো এতটাই রহস্যে ঢাকা যে বিজ্ঞানীরাও বলছেন, “আমরা এখনো এই প্রাণীর প্রায় কিছুই জানি না”।
সংরক্ষণ অবস্থা: বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে
IUCN-এর রেড লিস্টে মার্বেল বিড়ালকে Vulnerable হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে নজরদারি ও গবেষণা দুর্বল, সেখানে এদের অবস্থা আরও সংকটজনক।
চোরা শিকার, বন উজাড়, বনের ভেতরে মানুষ ও যানবাহনের অনুপ্রবেশ এই প্রাণীটির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো—বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে বাংলাদেশের বনে এমন একটি প্রাণী এখনো বাস করে।
কী করতে হবে?
- নিয়মিত ক্যামেরা ট্র্যাপ গবেষণা চালু করা প্রয়োজন, বিশেষ করে পার্বত্য বনাঞ্চলে।
- বন সংরক্ষণের পাশাপাশি কোর অভয়ারণ্য অঞ্চলকে আরও কড়াভাবে রক্ষা করতে হবে।
- স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দিয়ে সংরক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।
- শিশুদের প্রাকৃতিক শিক্ষায় এই প্রজাতি সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তি গুরুত্বপূর্ণ, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই জীববৈচিত্র্যকে চিনে ও রক্ষা করতে শিখে।
মার্বেল বিড়াল কোনো গল্পের চরিত্র নয়—এটি বাস্তব, জীবন্ত, এবং আমাদেরই বনে বাস করা এক নিঃশব্দ গর্ব।
এই প্রাণীর অস্তিত্ব শুধুই একটি প্রজাতির জীবন টিকিয়ে রাখার ব্যাপার নয়—এটি আমাদের বন, আমাদের পরিবেশ এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করার প্রতীক।