বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তঘেঁষা নেত্রকোনা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি নদী হলো সোমেশ্বরী নদী। মেঘালয়ের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিশাল অঞ্চলের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারায় প্রভাব ফেলেছে। এই নদীটির বয়স প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছর বলে ধারণা করা হয়, যদিও এটি আরও প্রাচীন একটি প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ হতে পারে। সোমেশ্বরী একটি মৌসুমি নদী হলেও বর্ষাকালে এটি দুরন্ত স্রোতধারায় পরিণত হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়।
বর্ষাকালে নদীর প্রাকৃতিক আচরণ
বর্ষার সময় সোমেশ্বরী নদীর রূপ ভয়ঙ্কর ও রহস্যময়। পাহাড়ি ঢল নামলে নদীর পানির প্রবাহ হঠাৎ করে প্রবল হয়ে ওঠে। তখন নদী প্রশস্ত হয়ে যায়, পানি ঘোলা হয়ে যায়, এবং তীব্র স্রোতে নদী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে নদীর স্রোতের গতি এতটাই তীব্র হয় যে পানির সঙ্গে ভেসে আসে প্রচুর পরিমাণে পাথর, বালু ও খনিজ পদার্থ। এই পাথরগুলো প্রধানত ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ঢলের সঙ্গে ভেসে আসে। কখনো কখনো ভারী বৃষ্টি হলে নদীর চর ও তীরবর্তী বসতিগুলোকেও প্লাবিত করে ফেলে। তবে সেইসঙ্গে এই সময় নদীর সৌন্দর্যও অনন্য হয়ে ওঠে। পাহাড়ি ঢলের শব্দ, পাহাড়ি মেঘের আনাগোনা আর উন্মত্ত স্রোত মিলিয়ে এটি এক অনন্য পর্যটন অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
শীতকালে নদীর রূপান্তর
শীত মৌসুমে সোমেশ্বরী একেবারে শান্ত ও শুষ্ক হয়ে যায়। নদীর জলস্তর তখন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় এবং কোথাও কোথাও শুকিয়ে ছোট ছোট জলাশয়ে পরিণত হয়। এই সময় নদীর তলদেশ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা পাথর ও খনিজ সংগ্রহের জন্য স্থানীয়দের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। স্থানীয় মানুষ—বিশেষত দুর্গাপুর, বিরিশিরি ও কাছাকাছি এলাকা থেকে আসা খনি শ্রমিকরা—নদীর শুকনো অংশ থেকে পাথর উত্তোলন করেন। পুরুষ ও নারী দলবদ্ধভাবে নদীতে নামেন, গামলা, ঝুড়ি ও কোদাল ব্যবহার করে বিভিন্ন আকার ও রঙের পাথর সংগ্রহ করেন।
নদীর পাথর ও খনিজ সম্পদ
সোমেশ্বরী নদীর প্রধান আকর্ষণ হলো এর নিচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের পাথর ও খনিজ পদার্থ। নদীর জলরাশি কমে গেলে দেখা যায়—কালো, ধূসর, লালচে, হলদেটে নানা রঙের গোল ও চ্যাপ্টা আকৃতির পাথর। এই পাথরগুলোর মধ্যে কিছু ব্যবহার করা হয় নির্মাণকাজে, কিছু ব্যবহৃত হয় শোভামূলক পাথর হিসেবে, আর কিছু বিক্রি হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া নদীর পাড়ে হাতে চালিত পদ্ধতিতে ‘ক্রাশার’ মেশিন বসিয়ে এসব পাথর চূর্ণ করে ‘চিপস’ তৈরি করা হয় যা নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
সোমেশ্বরী নদীর নিচে সিলিকা বালি এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থও পাওয়া যায়, যা প্রক্রিয়াজাত করে কাচ বা সিরামিক কারখানায় ব্যবহৃত হতে পারে। নদীর এই খনিজ সম্পদ স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে এবং হাজার হাজার পরিবার এই খনিজ উত্তোলন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত।
পর্যটন ও যোগাযোগ মূল্য
সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল—বিশেষ করে দুর্গাপুর-বিরিশিরি অঞ্চল—বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। নদীর স্বচ্ছ জল, চারপাশের পাহাড়, মেঘালয়ের পাথুরে সৌন্দর্য, গারো পাহাড়ের ঢালু, চিনামাটি পাহাড় এবং নেত্রকোনার বিখ্যাত নীল পানির লেক—সব মিলিয়ে এই এলাকাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিস্ময়। শীতকালে পর্যটকের ভিড় বেড়ে যায়। বিশেষ করে ভ্রমণপিপাসু তরুণ-তরুণীরা নৌকাভ্রমণ, নদীতে হাঁটা, পাথর কুড়ানো এবং স্থানীয় গারো ও হাজং জনজীবনের জীবনধারা দেখার জন্য আসে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বললে দেখা যায়, ময়মনসিংহ বা ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে নেত্রকোনা হয়ে দুর্গাপুরে পৌঁছানো যায় সহজেই। দুর্গাপুরে পৌঁছানোর পর ভ্যান, সিএনজি বা পায়ে হেঁটে নদীর বিভিন্ন অংশে যাওয়া যায়। দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরী নদীর মোহনায় যেতে খেয়া নৌকা বা ছোট ট্রলার ব্যবহার করা হয়, যা পর্যটকদের জন্য একটি আলাদা আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
একটি জীবনধারা।
সোমেশ্বরী নদী শুধু একটি নদী নয়, এটি একটি জীবনধারা। এটি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিকভাবে হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস। পাথর উত্তোলন থেকে শুরু করে পর্যটন সুবিধা—এই নদী নেত্রকোনা অঞ্চলের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তবে এই নদী ও এর পরিবেশ রক্ষায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। অতিরিক্ত পাথর উত্তোলন এবং দূষণের কারণে নদীর পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই সোমেশ্বরীর টেকসই ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।