রাজা সীতারাম রায় (১৬৫৮–১৭১৪) ছিলেন বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক অসাধারণ শাসক, যিনি যশোরের কাছাকাছি মোহাম্মদপুরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন রাঢ় বাংলার মহাপতিপুর গ্রামে, এক কায়স্থ পরিবারে। পিতা ছিলেন উদয়নারায়ণ দাস, যিনি ভুষণার ফৌজদারের অধীনে তহশিলদার হিসেবে কাজ করতেন।
শৈশবেই সীতারাম বাংলা, ফারসি, সংস্কৃত ও উর্দু ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তলোয়ার চালানো, ঘোড়ায় চড়া ও লাঠিখেলা শিখেছিলেন এবং তখন থেকেই একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন।
মোহাম্মদপুর: এক নতুন রাজধানীর জন্ম
শায়েস্তা খানের আমলে তিনি প্রথমে ভুষণায় চরমপন্থী ডাকাত করিম খানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে বাহাদুরি দেখান। এতে তিনি শায়েস্তা খানের প্রশংসা অর্জন করেন এবং নালদী পরগনার জায়গির লাভ করেন।
এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তিনি মোহাম্মদপুর নামে একটি সুসংগঠিত রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমান মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলা)। এই নগরী তিন দিক দিয়ে জলাভূমি ও নদী দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল। চারদিকে খাল কেটে দুর্গমুক্ত করা হয় এবং নগরীর ভেতরে দুর্গ, রাজপ্রাসাদ, মন্দির ও জলাধার নির্মাণ করা হয়। এখানে রাম সাগর, কৃষ্ণ সাগর, সুখ সাগর নামক বিখ্যাত দীঘিগুলি আজও তাঁর অবদানের সাক্ষ্য বহন করে।
রাজ্য বিস্তার ও প্রশাসন
সীতারাম রায় ধীরে ধীরে নালদী ছাড়িয়ে মধুমতী ও তার আশেপাশের বহু পরগনা দখল করেন। তিনি মেনা হাঁটি (রামরূপ ঘোষ), রূপচাঁদ ধালি, ফকির মাচকাটা প্রমুখকে সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর বাহিনীতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক ছিল এবং তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৭০০ শতকের শুরুতে তাঁর রাজ্য ৪৪টি পরগনায় বিস্তৃত ছিল, যার বার্ষিক রাজস্ব ছিল প্রায় এক কোটি টাকা। তাঁর রাজ্যে শিল্প, হস্তশিল্প ও কৃষিকাজের বিকাশ ঘটে।
মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম উশ শান ভুষণার ফৌজদার হিসেবে আবু তোরাপকে নিয়োগ দেন, যিনি কর আদায় ও ধর্মীয় দমন নীতি অনুসরণ করায় সীতারাম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি কর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং আবু তোরাপকে পরাজিত করেন।

এরপর মুঘল বাহিনী বারবার আক্রমণ চালালেও সীতারাম দক্ষতা ও কৌশলে তাদের প্রতিহত করেন। একটি বড় সংঘর্ষ ঘটে বরাসিয়া ও ভুষণার মধ্যে, যেখানে সীতারামের বাহিনী আবু তোরাপকে হত্যা করে এবং ভুষণা দুর্গ দখল করে।
মুঘলদের চূড়ান্ত আক্রমণ ও পতন
মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খান নিজের আত্মীয় বক্স আলি খান ও দিঘাপতিয়া জমিদার দয়ারাম রায়কে পাঠান। তারা একযোগে মোহাম্মদপুর ঘিরে ফেলেন। দয়ারাম রায় কৌশলে সীতারামের প্রধান সেনাপতি মেনা হাঁটিকে হত্যা করেন এবং তার কাটা মাথা নবাবের কাছে পাঠান। এতে সীতারামের সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদপুর দখল হয় এবং সীতারাম বন্দি হন। ১৭১৪ সালে তাঁকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে গিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর পরিবার ও উত্তরসূরিরা বন্দি অবস্থায় জীবন কাটান।
উত্তরাধিকার ও স্মৃতি
রাজা সীতারাম রায় ছিলেন মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত ও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহের অন্যতম নেতা। তাঁর মোহাম্মদপুর আজও ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে। তিনি কেবল যুদ্ধনেতা ছিলেন না, বরং একজন জনহিতৈষী শাসক হিসেবে দীঘি, মন্দির, নগর উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কার করে গেছেন।
বাংলার ইতিহাসে তাঁর নাম আজও যশোর-মাগুরা অঞ্চলে স্মরণীয় হয়ে আছে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, যদি সীতারাম সফল হতেন, তাহলে দক্ষিণ বাংলায় একটি শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠতে পারত।
রাজা সীতারাম রায় ছিলেন এক সাহসী ও দূরদর্শী শাসক, যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব থেকে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা, কৌশলী যুদ্ধনীতি ও জনকল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য ও বীর প্রতিভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।