ঢাকার অভিজাত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা মোহাম্মদপুর সম্প্রতি একাধিক ছিনতাই, খুন এবং সশস্ত্র হামলার ঘটনায় কেঁপে উঠেছে। এই এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা ক্রমাগতভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্ক ও ক্ষোভের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে কয়েকটি গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সাংবাদিক দম্পতির ওপর সশস্ত্র ছিনতাই, একজন তরুণের প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে মৃত্যু এবং একটি গ্যাংচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার উল্লেখযোগ্য।
সাংবাদিক দম্পতির ওপর সশস্ত্র হামলা
২৪ জুলাই রাতে মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড়ে সাংবাদিক আহমদ ওয়াদুদ ও তার স্ত্রী বাসায় ফেরার পথে একটি রিকশায় করে ফিরছিলেন। সেই সময় হঠাৎ তিনজন ছিনতাইকারী রাস্তায় এসে রিকশা থামিয়ে দেয়। একজন দুষ্কৃতিকারী হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে সাংবাদিকের হাতে আঘাত করে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরদিন থানায় অভিযোগ করার পর মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে তিন ছিনতাইকারী—ইউসুফ, সিয়াম ও জহুরুল—কে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। তবে এই ঘটনার পর স্থানীয় জনগণের ক্ষোভ চরমে পৌঁছে যায়। তারা মোহাম্মদপুর থানার এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্যাংদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনে বিক্ষোভ করে এবং তার অপসারণ দাবি করে।
তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা
২৬ জুলাই দিবাগত রাতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনের সড়কে আরও একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। ফজলে রাব্বি সুমন নামের এক তরুণ, যিনি বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন, তাকে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ঘটনার সময় তার সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা, কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে হাঁটুর নিচে ছুরিকাঘাত করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ড পুরো এলাকাকে নাড়িয়ে দেয় এবং মানুষজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে।
র্যাব-২ এর অভিযান ও ‘ভাইরাল আলভি’ গ্রেফতার
জুলাই মাসের শুরুতে মোহাম্মদপুরের ৪০ ফুট এলাকায় র্যাব-২ একটি অভিযান চালিয়ে তিনজন অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে। তাদের একজন পরিচিত মুখ—‘ভাইরাল আলভি’ নামে পরিচিত মশারাফ হোসেন। অভিযোগ ছিল, তারা সশস্ত্র ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের কাছ থেকে চাপাতি ও অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন কিশোরও ছিল, যাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
ডিবি পুলিশের গ্রেফতার অভিযান
১৭ জুলাই শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ আরও তিন ছিনতাইকারী—আল-আমিন, আসলাম সিকদার ও কবির—কে গ্রেফতার করে। তারা মোটরসাইকেলে চলন্ত মানুষের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাগ ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিতেন। তাদের কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল ও চাপাতি উদ্ধার করা হয়।
কিশোর গ্যাং ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া
উপরোক্ত ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা কিশোর গ্যাং ও মাদক ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী চক্র এলাকাজুড়ে প্রভাব বিস্তার করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই গ্যাংদের সঙ্গে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের যুব শাখার সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি পুলিশের একাংশও এই গ্যাংদের কার্যকলাপে নীরব থেকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অতীতের অপরাধীদের মতো এখন একদল তরুণ আবারও অপরাধ জগৎ গড়ে তুলছে।
করণীয়: নাগরিক-প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি
এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয়, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এলাকাজুড়ে পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, নিয়মিত টহল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। নাগরিক সমাজও এগিয়ে এসেছে; স্থানীয় শিক্ষার্থীরা গ্যাং ও মাদকমুক্ত মোহাম্মদপুর গড়ার লক্ষ্যে মানববন্ধন, সচেতনতামূলক র্যালি এবং সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের এসব ঘটনার পেছনে সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা এবং গ্যাং সংস্কৃতির প্রভাব একসাথে কাজ করছে। এখনই সময়—নাগরিক, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব—এই তিন পক্ষের যৌথ উদ্যোগে মোহাম্মদপুরকে আবারও নিরাপদ করে তোলার। তা না হলে একদিন এই গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকা পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।