এশিয়ার সুপার-ধনীদের জীবন উত্থান-পতনে ভরা। তবে একটি খাত রয়েছে, যা এই উত্থান-পতনের সরাসরি প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে—প্রাইভেট জেটের ব্যতিক্রমী বাজার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে বিলাসবহুল প্রাইভেট বিমান নিবন্ধনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে, যার একটি বড় কারণ হলো ধনসম্পদের প্রকাশ্য প্রদর্শন নিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অসন্তোষ। অন্যদিকে ভারতের উঠতি ধনীরা এখন ঝকঝকে ব্যক্তিগত বিমানের দিকে ঝুঁকছেন।
প্রাইভেট জেট নির্মাতারা বহু আগে থেকেই ধরে নিয়েছেন, ভবিষ্যতের বড় বাজার হবে এশিয়া। একটি পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল পর্যন্ত এশিয়ায় প্রাইভেট জেট বিক্রির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ; যেখানে বৈশ্বিক হারে তা ৪ শতাংশ এবং আমেরিকায় মাত্র ১ শতাংশ (যেখানে ইতোমধ্যেই বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ প্রাইভেট জেট রয়েছে)।
চীনের ধনী শ্রেণির চাহিদাই একসময় এশিয়ার দালালদের বিত্তশালী করে তুলেছিল। ২০০০ ও ২০১০-এর দশকে চীনা ধনকুবেররা নিয়মিত আকাশে উড়তেন। এখনও চীনে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি প্রাইভেট জেট রয়েছে, তবে এই ব্যবধান দ্রুত কমছে। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চীনের প্রাইভেট জেটের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৪৯টিতে (তথ্যসূত্র: এশিয়ান স্কাই গ্রুপ)।
কোভিড নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভ্রমণ বিধিনিষেধ এই পতনের একটি কারণ হতে পারে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আবাসন খাতের ধস এবং সরকারের ‘ধনকুবের শাসন রোধ’ নীতির কারণে চীনা ধনীদের সম্পদ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালে চীনে ডলার বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ১,১৮৫ (বিশ্বের মোটের ৩৭ শতাংশ), যা এরপর এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা সরকার আবারও ব্যয়সংযম অভিযান শুরু করেছে। সরকারি বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় খরচ রোধই এর লক্ষ্য। তাই সরকারি অনুষ্ঠানে মদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মিটিং কক্ষে অতিরিক্ত ফুল সাজানো নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। ফলে যাদের হাতে বিপুল অর্থ রয়েছে, তারাও এখন টাকা খরচে সাবধান হচ্ছেন।
কিন্তু হিমালয় পার হলেই ভারতের দৃশ্যপট পুরোপুরি আলাদা। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে প্রাইভেট জেট নিবন্ধনের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশ বেড়ে ১৬৮টিতে পৌঁছেছে। মাসিক প্রাইভেট ফ্লাইটের সংখ্যা তিন গুণ হয়ে ২,৪০০ ছাড়িয়ে গেছে—যা পুরো মহাদেশে সর্বোচ্চ। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত, এশিয়ার দশটি ব্যস্ততম প্রাইভেট রুটের মধ্যে চারটিই ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ: মুম্বাই থেকে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, আহমেদাবাদ এবং পুনে। এর কোনো রুটেই চীনের কোনো বিমানবন্দর নেই।
ভারতে এই ইতিবাচক ধারা শুরু হয় ২০২১ সালে, জানিয়েছেন কানাডিয়ান বিমান নির্মাতা বম্বারডিয়ারের সাবেক বিক্রয় প্রতিনিধি বিনোদ সিংগেল। “ঠিক তখনই আমি প্রকৃত উত্থান দেখি।” আগে প্রাইভেট জেট কোম্পানিগুলো ভারতের দিকে নজর দিত না। এখন তারা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পোলো ম্যাচ পর্যন্ত আয়োজন করছে।
“নতুন প্রজন্মের সুপার ধনী গ্রাহকরা এখন বাজারে,” বলছেন বিমান অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী নীতিন সারিন। “আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন শুধু বড় করপোরেট গ্রুপের প্রধানরাই প্রাইভেট জেট কিনতেন।” এখন নির্মাণ, গহনা, ওষুধ এবং শিক্ষা খাত থেকেও ক্রেতারা আসছেন। অনেকেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির শহর থেকে। “তারা ইতোমধ্যেই তাদের মেবাখ ও রোলস-রয়েস কিনে ফেলেছেন,” বলেন সারিন।
ভারতীয় ক্রেতারা চীনা ক্রেতাদের চেয়ে ভিন্ন পছন্দ করেন। চীনে যেখানে ‘দেখানোর’ প্রবণতা কাজ করে, সেখানে ভারতীয়রা ব্যবহারিক দিকটি গুরুত্ব দেন। “গলফ খেলতে ছোট জেট নিয়ে গেলে লজ্জা,” বলেন ডেনিস লাউ (ASG)। তাই চীনের ধনীরা দীর্ঘপথে ব্যবহারের উপযোগী বড় জেট কিনতে পছন্দ করেন, যদিও সেগুলোর প্রয়োজন নাও থাকতে পারে।
ভারতীয়রা ছোট ও কার্যকর মডেল কিনে বেশি ব্যবহার করেন। চীনে স্বল্প দূরত্ব কভার করার জন্য হাইস্পিড রেল বা নতুন মহাসড়ক আছে। ভারতে এমন সুবিধা নেই। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য এখনো বিমান সময়সূচি যথেষ্ট নয়। “কমার্শিয়াল ফ্লাইটে যাওয়া সহজ নয়,” বললেন ব্যবসায়ী বিমানের দালাল রোহিত কাপুর। “ভারতের যেকোনো লাউঞ্জে ঢুকলে দেখা যায়—পাঁচশো লোক ক্রেডিট কার্ড হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে।”
ভারতীয় ধনীরা দরকষাকষিতে চীনা ক্রেতাদের চেয়েও বেশি কৌশলী। একজন দালাল জানান, এক চীনা ক্রেতা গলফ ক্লাবে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের একটি জেট কিনছিলেন—ঠিক তখন পাশে থাকা তার বন্ধু হঠাৎ করেই একই মডেল কিনে ফেলেন। ভারতে এমন ঘটনা প্রায় ঘটে না। ১০০ মিলিয়ন ডলারের জেটেও “শীর্ষস্থানীয় ক্রেতারা” ৫ হাজার ডলার কমানোর জন্য দরকষাকষি করেন। “এখানে কেউই অযথা খরচ করেন না।”
এই হিসাবি মানসিকতা বোঝার জন্য মালিকানা খরচ জানা জরুরি। প্রাইভেট জেটের দাম ৩ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে, আকার, পরিসীমা ও বয়সের ওপর নির্ভর করে। এর ওপর ২৮% হারে কর দিতে হয় (যদিও অনেকে মাঝে মাঝে জেট ভাড়া দিয়ে থাকেন, এতে কর কমে ৫% হয়ে যায়)। একটি ১০ মিলিয়ন ডলারের জেটের বার্ষিক নির্দিষ্ট খরচ ১ থেকে ১.৫ মিলিয়ন ডলার—এতে জ্বালানি, পার্কিং ও ল্যান্ডিং ফি অন্তর্ভুক্ত নয়।
যদি বাজার এমনই বাড়তে থাকে, তবে সাধারণ ভারতীয়রাও এর কিছু খরচের বোঝা টের পেতে পারেন। প্রাইভেট ফ্লাইটগুলো প্রতি যাত্রী মাথায় সাধারণ বিমানের তুলনায় অনেক বেশি কার্বন নিঃসরণ করে এবং ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোকে আরও চাপের মুখে ফেলে। ভারতে ছোট এয়ারস্ট্রিপ নেই বললেই চলে—যেখানে আমেরিকায় আছে ১৬,০০০, ভারতে মাত্র ৩০০টি। তবে সরকার বিমানবন্দর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, আর সেই সঙ্গে জেটের সংখ্যাও বাড়ছে। এখন কম ধনী মিলিয়নিয়ারদের লক্ষ্য করে প্রাইভেট চার্টার সেবাও বাড়ছে। পশ্চিমা মডেল অনুসরণ করে অন-ডিমান্ড চার্টার ও টাইমশেয়ার ব্যবস্থাও চালু হচ্ছে।
ভারতে এই খাত এখনো চীনের মতো সরকারি হস্তক্ষেপে আটকে পড়েনি। তবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা এলে এই উড়ন্ত সাফল্যের ডানা ছাঁটা পড়তে পারে। মন্দা শুরু হলে, “প্রথম যে জিনিসটি বাদ যাবে, সেটি হবে কোম্পানির জেট,” সতর্ক করেন কাপুর।