সেই চাকচক্যে হেষ্টিংস সাহেবের চক্ষু ঝলসিত হইয়া যায়। দেবীসিংহ মুর্শিদাবাদসমিতির সহকারী কাৰ্য্যাধ্যক্ষ নিযুক্ত হইয়া, সেই সমস্ত তরুণবয়স্ক ইংরেজ যুবকদিগকে হস্তগত করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তৎকালে নর্তকীগণের উপর কর স্থাপন করিয়া অনেক টাকার রাজস্ব সংগ্রহ হইত। দেবীসিংহ এই কার্য্যের জন্ত বিশেষ যত্নবান্ হইলেন। এই সময়ে তিনি দেখিলেন যে, তাঁহার উচ্চতম কৰ্ম্মচারিগণ সকলেই অল্পবয়স্ক যুবক। যৌবনের প্রারম্ভে যাবতীয় বিলাস-প্রবৃত্তি তাঁহাদের হৃদয়মধ্যে ক্রীড়া করিয়া বেড়াইতেছে।
সেই বিলাস-প্রবৃত্তির সহায়তার জন্ত দেবীসিংহ নর্তকীদিগের মধ্য হইতে কতকগুলি সুন্দরী ও সুগায়িকা লইয়া তাঁহাদিগকে প্রতিনিয়ত উপহার প্রদান করিতে লাগিলেন। এক কথায় দেবী সেই সমস্ত ইংরেজ যুবকদিগের জন্য একটি নর্তকীসমাজ গঠন করিলেন এবং যখনই তাঁহাদের বিলাস-প্রবৃত্তির পরিতুষ্টির প্রয়োজন হইত, অমনি দেবীসিংহ তাহাদিগকে লইয়া উপস্থিত হইতেন। দৌলৎজান, দেলখোশ প্রভৃতি তাহাদের সুমধুর নাম, শ্বেতাঙ্গ যুবকদিগের কর্ণে ভাল লাগিত। তাঁহারা ‘বার্ক লিখিয়াছেন যে, দেবী সিংহ তাহাদিগকে ঐ সকল সুমিষ্ট নামে অভিহিত করিত, কিন্তু সে কথা প্রকৃত নহে।
এতদ্দেশে নর্তকীগণের সাধারণতঃ ঐ সকল নাম দেখা যায়, তাহারাই ইচ্ছা করিরা ঐ সকল নাম ব্যবহার করে। সুতরাং দেবীসিংহকে নূতন করিয়া ঐ সমস্ত নাম প্রদান করার বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না। তাহাদিগকে লইয়া অশেষপ্রকার আমোদ উপভোগ করিতেন। কখনও বা মুর্শিদাবাদের ভিন্ন ভিন্ন উত্থানে, কখনও বা ভাগীরথীবক্ষে ময়ূরপঙ্ক্ষী আরোহণে সেই সুকল্পীগণের কলকণ্ঠ ও কুটিল কটাক্ষ তাঁহাদিগকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় করিয়া রাখিত। সেই সময়ে ফরাসীদেশজাত সুস্বাদু ম্য তাঁহাদের আমোদের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করিত। এতদ্ভিন্ন সুগন্ধি চুরুটের ত কথাই ছিল না।
তাঁহাদের স্বদেশীয় ও বিদেশীয় যত প্রকার আমোদের সম্ভব, সকলেরই অভিনয় চলিতে থাকিত। যখন সেই তপ্তকাঞ্চনবর্ণী পূর্ণদেহা নর্তকীগণ ফরাসীদেশজাত মদ্যে গণ্ডস্থল রক্তিম করিয়া ঢুলু ঢুলু নয়নে ও অর্দ্ধস্খলিত স্বরে নানারূপ বিভ্রমচেষ্টা দেখাইত, তখন সেই সুরামত্ত যুবকগণ যেরূপ পাশব প্রবৃত্তির পরিচর প্রদান করিত, তাহা লিখিয়া লেখনী কলঙ্কিত করা যায় না। তখন তাহারা সুসভ্য’ ইউরোপের সন্তান বলিয়া আপনাদিগকে ভুলিয়া যাইত এবং নিতান্ত অসভ্য বা ইতর জাতির বংশধরের ন্যায় আপামর সাধারণের চক্ষে প্রতিপন্ন হইত। আমরা ইংরেজী ইতিহাসে মুসল্মান বাদশাহ ও নবাবদিগের এইরূপ বিলাসিতার অনেক চিত্র দেখিয়া থাকি।
শ্রী নিখিলনাথ রায় 



















