দেবী সিংহ
যদি কেই অত্যাচারের বিভীষিকাময়ী মূর্ত্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানব প্রকৃতির মধ্যে শয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে তিনি একবার দেবীসিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন; দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে! কত কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জন দিয়াছে! কত কত জমিদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে! কুল-ললনার পবিত্রতা-হরণ, ব্রাহ্মণের জাতিনাশ, মানীর অপমান, এই সকল পৈশা-চিক কাণ্ডের শত শত দৃষ্টান্ত ছত্রে ছত্রে দেখিতে পাইবেন।
দেবীসিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমল-হৃদয়া মহিলা মুচ্ছিতা হইয়া পড়েন! শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর। ক্রোড়ে আশ্রয় লয়! সমগ্র মানবজাতির ইতি-হাসে এরূপ পাশব অত্যাচারের দৃষ্টান্ত অধিক নাই বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। মানুষ হইয়া মানুষের প্রতি এরূপ নির্দয় ব্যবহার কখনও সম্ভবপর কি না, তাহা আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারি না। সে চিত্র অঙ্কিত করিতে কল্পনা স্বয়ংই ভীত ও চকিত হইয়া উঠে। মানুষ কখনও সে চিত্র দেখাইতে পারে না; দেখাইতে হইলে, অমানুষী ক্ষমতার প্রয়োজন।
কঠোরতার হৃদয় না বাঁধিলে, তাহার পূর্ণ চিত্র অঙ্কিত করা দুঃসাধ্য। মহামতি বার্ক ইংলণ্ডের মহাসমিতির নিকট সেই অত্যাচারকাহিনী বর্ণনা করিতে করিতে এরূপ অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, আর অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। তথাপি তাঁহার সেই অবিনাশিনী বর্ণনা হইতে, আজ আমরা দেবী সিংহের পৈশাচিক চরিত্রের যে চিত্র দেখিতে পাই, তাহাতেই স্তম্ভিত হইতে হয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন-“পৃথিবীর ওপারে ওয়েস্টমিনিষ্টার হলে দাঁড়াইয়া, এদ্মন্দ বর্ক দেবীসিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন।
পর্ব্বতোদগীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বর্ক দেবীসিংহের দুর্ব্বিণহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাঁহার নিজ মুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া, শোকে অনেক স্ত্রীলোক মুর্জিত হইয়া পড়িয়াছিল-আজিও শত বৎসর পরে, সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে, শরীর লোমাঞ্চিত ও হৃদয় উন্মত্ত হয়।” নৃশংস দেবীসিংহের অত্যাচারে সমগ্র উত্তরবঙ্গ হাহাকারধ্বনিতে পূর্ণ হইয়া উঠে। রঙ্গপুর, দিনাজপুর-প্রভৃতি প্রদেশ মহাশ্মশানে পরিণত হয়। কোম্পানীর রাজত্বারন্তে বাঙ্গলাদেশে যে মূর্ত্তিমী অরাজকতা দেখা যায়, দেবীসিংহের অত্যাচার তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান অধিকার করে।