যখন দেবীসিংহ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারিগণ তাঁহার প্রতারণা বুঝিতে পারিয়াছেন, তখন তিনি তাঁহাদিগকে অনুনয়-বিনয়ে শান্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অবশেষে স্বীয় সঞ্চিত অগাধ অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, তাঁহাদিগকে বশীভূত করিতে ইচ্ছা করিলেন। তিনি প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এবং সকলকে এক সঙ্গে নানারূপে অর্থের প্রলোভন দেখাইতে লাগিলেন। কিন্তু এবার তাঁহার সকল কৌশল ব্যর্থ হইল। সমিতির সভ্যগণ একবাক্যে তাঁহার উৎকোচ অগ্রাহ্য করিলেন। কিন্তু দেবীসিংহ কিছুতেই বিচলিত হইবার লোক নহেন।
তিনি তলে তলে হেষ্টিংস সাহেবকে বশীভূত করিয়া ফেলিলেন। হেষ্টিংস নিজেও বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, দেবীসিংহ যে অর্থ সঞ্চয় করিতেনালী তাহার কতক অংশ তাঁহার নিজের হস্তগত হইবেই হইবে। তাই দেৰীসিংহকে পদচ্যুত করা দূরে থাকুক, তিনি অচিরকালমধ্যে মুর্শিদাবাদ প্রাদেশিক-সমিতি ভঙ্গ করিবার আদেশ দিলেন। দেবীসিংহের জন্য তিনি কোম্পানীর ক্ষতি করিতেও ত্রুটি করিলেন না। স্বদেশীয় কৰ্ম্ম-চারিগণকে অবমানিত করি। এবং দেশের যাবতীয় ‘লোকের অনুনয় উপেক্ষা করিয়া হেষ্টিংস দেবীসিংহকে রক্ষা করিতে প্রস্তুত হইলেন।
যে কোম্পানীর প্রতিনিধিস্বরূপ হইয়া তিনি ভারতশাসন করিতেছিলেন, সেই কোম্পানীর লাভালাভের দিকে কিছুমাত্র দৃষ্টি করিলেন না। যে তাঁহাকে অর্থ দিয়া বশীভূত করিতে পারিত, তিনি তাহার পরিপোষক হইয়া, ন্যায়, ধৰ্ম্ম, সমস্তই অকাতরে বিসর্জন দিতে পারিতেন। হেষ্টিংস মুশিদাবাদ প্রাদেশিক-সমিতি ভঙ্গ করিলেন, অথচ দেবীসিংহকে একটু সামান্ত তিরস্কার পর্যন্তও করিলেন না। দেবীসিংহকে কোনরূপ দণ্ড দেওয়া দূরে থাকুক, তাঁহাকে পুনর্ব্বার দিনাজপুর, রঙ্গপুর, ইদ্রাকপুর প্রভৃতির ইজারা প্রদান করিয়া, দিনাজপুরের নাবালগরাজার দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া দিলেন।
এই দিনাজপুর প্রদেশই দেবীসিংহের অত্যা-চারের প্রধান রঙ্গভূমি। গঙ্গাগৌবিন্দ সিংহ প্রবন্ধে উল্লিখিত হইয়াছে যে, দিনাজপুরের রাজা বৈশ্বনাথ প্রাণত্যাগ ক্রুরায়, তাঁহার দত্তক পুত্র রাধানাথ ও ভ্রাতা কান্তনাথের মধ্যে বিষয়প্রাপ্তি লইয়া গোলযোগ উপস্থিত হয়। অবশেষে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের পরামর্শে সকৌন্সিল গবর্ণর জেনারেল রাধানাথকেই” উত্তরাধিকারী স্থির করেন। এই সময়ে রাধানাথের বয়স ১৬ বৎসর মাত্র; সুতরাং তাঁহার অভিভাবকস্বরূপ হইয়া দিনাজপুরের জমিদারী পরিচালনের জন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তির প্রয়োজন হইল।
শ্রী নিখিলনাথ রায় 



















