দেবীসিংহ ইজারা লইয়া জমিদার ও প্রজা উভয়েরই প্রতি ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করি-লেন। হররাম নামে এক পিশাচপ্রকৃতির মনুষ্য তাঁহার সহকারী নিযুক্ত হইয়া, দেশমধ্যে ভয়াবহ ‘কাণ্ডের ক্রীড়া দেখাইতে লাগিল। কি জমিদার কি প্রজা, কি পুরুষ, কি স্ত্রী কাহারও বিন্দুমাত্র নিষ্কৃতি ছিল না। এরূপ লোমহর্ষণ অত্যাচার কেহ কখনও দেখে নাই, বা কেহ কখনও শুনে নাই। দেবীসিংহের পূর্ণিয়ার অত্যাচারের কথা দিনাজপুর প্রদেশের লোকেরা পূর্ব্ব হইতেই জানিত। যে সময়ে তাহারা শুনিল যে, দেবী সিংহ দেওয়ান হইয়া, দিনাজপুর প্রদেশে আগমন করিতেছে, তদবধি তাহাদের হৃদয়ে মহাভীতির সঞ্চার হয়; এবং তাহারা আপনাদিগের ধনপ্রাণ বিঘ্নসংকুল মনে করিয়া, দেশ পরিত্যাগ করিতে কৃতসম্বর হয়।
কিন্তু কিঞ্চিন্মাত্র অত্যাচার ভোগ না করিয়া, কেহই দেশ পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয় নাই। আমরা ক্রমান্বয়ে সেই অত্যাচার-কাহিনী বিবৃত করিতে চেষ্টা পাইতেছি। ইজারা গ্রহণ করিয়া দেবী সিংহ জমিদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদের উপর অসম্ভব কর স্থাপন করিলেন। যেরূপ বর্দ্ধিত হারে করদানের জন্য তাহাদিগকে বাধ্য করা হয়, তাহারা শত চেষ্টায়ও কদাচ তাহা সংগ্রহ করিতে পারিত না। এইরূপ করপ্রদানে যাহারা অস্বীকৃত হইত, দেবী সিংহ অমনি তাহাদিগকে কারাগারে প্রেরণ করিয়া, অশেষরূপে পীড়ন করিতেন।
জমিদারগণ রজ্জুবদ্ধ ও শৃঙ্খলবদ্ধ হইয়া, অবশেষে দেবী সিংহের প্রস্তাবে সম্মতি দান করিতেন। কিন্তু কোনরূপেই তাঁহার প্রস্তাবানুযায়ী কাৰ্য্য করিয়া উঠিতে পারিতেন না। কেহ একবার কোন প্রস্তাবে স্বীকৃত হইলে, তাহার আর নিস্তার ছিল না। দিন দিন নূতন নূতন করপ্রদানের জন্ত সকলে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিত। অবশেষে যখন জমিদারগণ নিতান্ত অসমর্থ হইয়া পড়িতেন, তখন রাজস্ব অনাদায়ের জন্য তাঁহাদের সমস্ত জমিদারী অল্পমূল্যে বিক্রীত হইয়া যাইত। বলা বাহুল্য, দেবী সিংহ নিজেই সেই সমস্ত জমিদারীর ক্রেতা; তিনিই শূল্য নির্ধারণ করিতেন, তিনিই বিক্রয় করিতেন, পরে বেনামীতে নিজেই কিনিয়া লইতেন। যাহারা পুরুষানুক্রমে লাখেরাজ ভূমি ভোগ করিয়া আসিতেছিল, তাহারাও অবশেষে সে সকল পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হয়।
জমিদারী বিক্রয় করিয়াও যখন তাঁহার প্রস্তাবানুযায়ী অর্থের সংকুলান হইত না, তখন সেই সমস্ত লোকদিগের অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া,. কিয়ৎপরিমাণে অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করা হইত। এই সময়ে দিনাজপুর প্রদেশে অনেক স্ত্রী-জমিদারও ছিলেন; তাঁহা-দের মধ্যে অনেকেই সম্ভ্রান্ত মহিলা। এই সকল মাননীয়া মহিলাবৃন্দও দেবীসিংহের হস্তে ঘোর অত্যাচার ভোগ করেন। দেবীসিংহ সেই সমস্ত স্ত্রী-জমীদারদের ভবনের চতুদ্দিকে প্রহরী নিযুক্ত করিয়া, নাজির ও পদাতিক দ্বারা তাঁহাদিগের ধন, রত্ন, অলঙ্কারাদি ক্রোক করিয়া লই-তেন।
সুখের বিষয়, এই সকল কার্য্যে স্ত্রীলোকই নিযুক্ত হইত। সেই সমস্ত মহিলাগণ অত্যন্ত উৎপীড়িত হইয়া সামান্যবেশে আপনাদিগের বাসস্থান পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। সূর্যাকিরণও কখনও। যাঁহাদিগের কোমল অঙ্গ স্পর্শ করিতে পারে নাই, আজ তাঁহারা নিরা-শ্রয়া হইয়া দীনবেশে অরণ্য ও কুটীরে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর, দেবসেবা, অতিথিসেবা ও ব্রাহ্মণসেবার জন্ত যে সমস্ত জমি নিদ্দিষ্ট ছিল, দেবীসিংহ কৌশলপূর্ব্বক তাহাও আত্মসাৎ করিলেন।
শ্রী নিখিলনাথ রায় 



















