০৬:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
ভারতে জার্মান কায়দায় রিসিন সন্ত্রাস হামলার প্রস্তুতির অভিযোগ গুজরাটে রিচিন হামলা ষড়যন্ত্র: মুজাফ্‌ফরনগরের একই মাদ্রাসায় পড়তেন দুই অভিযুক্ত কাফরুল থানার সামনে ককটেল নিক্ষেপ: পালানোর সময় যুবক আটক তাইওয়ানি ইনফ্লুয়েন্সারের মৃত্যু: মালয়েশিয়ান র‍্যাপার নেমউই জামিনে মুক্ত, তদন্ত চলছে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন নেটওয়ার্কে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বিএনপি-জামায়াতের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে লাভবান হচ্ছে আওয়ামী লীগ – নাসিরউদ্দিন মালয়েশিয়ায় ৪০০–এর বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের বেতন বঞ্চনা ও জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর অভিযোগ ‘ঢাকা লকডাউনে’র দিনে সকাল থেকে যে পরিস্থিতি দেখা গেল ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা ২: টিজার ফিরল — পুরনো রাগ, নতুন অবস্থা হুট করে যাওয়ার সংস্কার — শেষ মুহূর্তের ভ্রমণে বাজার বদল

জুলাই সনদ, ১/১১-এর কিংস পার্টি, ২০০৮-এর নির্বাচনের গায়ে কালি দেওয়া

মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই সনদ ঘোষণা করেছেন, সেটা যে অধ্যাপক লিখেছেন তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও সুব্রত রায় চৌধুরীর (সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদসহ আরও অনেকের ইনপুট ছিল) লেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অনুকরণ করেছেন।

কিন্তু বেসিক পার্থক্যটা থেকে গেছে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও সুব্রত রায় চৌধুরী সবাই আইনজীবী—তাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতিটি শব্দে আইনগত দিকটি স্পষ্ট করা হয়েছে।

আর মুহাম্মদ ইউনূসকে যে অধ্যাপক লিখে দিয়েছেন, তিনি মোটেই আইনের মানুষ নন, তাই মূলত এখানে আইনের বিষয়গুলো মোটেই স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি বা অনুকরণ করা হয়নি। প্রকৃত অর্থে অনুকরণ করা হয়েছে মূলত দুটি শব্দ—“এবং” ও “যেহেতু”।

তাছাড়া যারা জুলাইয়ের আন্দোলনটি করেছিল বলে দাবি করে, তাদের বক্তব্যও কিন্তু পরিষ্কার নয়—তারা কি জুলাই সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সিস্টেমের পরিবর্তন চায়, না ভবিষ্যতে নিজেদের নিরাপত্তা বা বিচারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটা সাংবিধানিক গ্যারান্টি চায়। যে মেয়েটি সম্প্রতি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম; সে বলছিল, যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে—তাহলে হয় আমরা রাস্তায় মারা যাব, না হয় আমাদের বিচারিকভাবে মারা যেতে হবে।

তাই জুলাই সনদে তাদের এ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি বড় ছিল। তার জন্যে আইনগত একটা কাঠামো তৈরির চেষ্টা থাকবে—এমনটি অনেকে ভেবেছিলেন। কিন্তু এখানে বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে আইনগতভাবে এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। যেহেতু পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাই তাদের ভয়ের বিষয়টি আওয়ামী লীগ থেকে নয়, আইনের ভয়। কারণ, যখনই আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে এবং তারা মব-শক্তি হারিয়ে ফেলবে—তখন আইন তাদের কীভাবে সুরক্ষা দেবে?

বিষয়টি জটিল। কোন অর্থনীতির বা পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপকের পক্ষে এ গ্যারান্টি তৈরি করা কঠিন। আর আমাদের মতো সাংবাদিকদের পক্ষে ওই আইনের সাগরে ডুব দেওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। তবে তারপরেও বলা যায়—বিষয়টি জটিল। কারণ, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই ইনডেমনিটি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন ঘটনায়। এবারের এই পুলিশ হত্যার বিচার নিয়ে ইনডেমনিটি মোট চারবার দেওয়া হলো  এদেশে। তবে সংবিধানের অংশ করা হয়েছিল পঞ্চম সংশোধনীতে একটি মাত্র ইনডেমনিটিকে।

যাহোক, সাধারণ জ্ঞানে বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধ্যায় ও সংবিধানের ২৬(২) বজায় রেখে যে কোনো ইনডেমনিটি দিলে তা সংবিধানের গার্ডিয়ান বিচারবিভাগ বা সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেবে স্বাভাবিক নিয়মে। আর যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানের জেনেসিস (Genesis) স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের জেনেসিসকে পরিবর্তন করা যায় না—এ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর একটি রায়ও আছে। সেখানেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে জেনেসিস বা মাতৃজনন কোষ বলেই উল্লেখ করেছেন।

তাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেহেতু পরিবর্তন সম্ভব নয়, যেহেতু এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের জেনেসিস, তাই সংবিধানের মৌলিক অধ্যায় পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই। অর্থাৎ সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের যে মৌলিক অধিকার রক্ষা করা হয়েছে তা আইনত পরিবর্তন করার ক্ষমতা কেউ রাখে না। এবং সংবিধানের পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন বলতে সংবিধানের মৌলিক অধ্যায়ে হাত দেওয়া বোঝায় না। যাহোক, বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই এটা নির্বাচিত সংসদ ও বিচার বিভাগের বিষয়।

তবে জুলাই সনদে আরও অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে ২০০৮-এর নির্বাচনকে অনেকটা ষড়যন্ত্রমূলক ও সঠিক নির্বাচন নয় বলা হয়েছে।

২০০৭-এর ১/১১ সরকার ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে এসেছিল, না পরিস্থিতিই ওই সরকারকে আসতে বাধ্য করেছিল—এটা বড় প্রশ্ন। ওই বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখার আকার যেমন বড় হয়ে যাবে, তেমনি লেখাও ভিন্ন দিকে চলে যাবে।

তবে ১/১১-এর সরকার একটি ষড়যন্ত্রমূলক সরকার ছিল না; দেশকে একটি ভালো নির্বাচন দেওয়ার জন্যে গঠিত হয়েছিল—সেটা মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের থেকে ভালো জানেন। কারণ, ওই সময়ে ওই সরকারের সমর্থনে তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দল করেন। এবং কেন তিনি দল তৈরি করেছিলেন, কারা তাকে উৎসাহিত করেছিলেন—তার কিছু অংশ সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরও জানা। তবে ড. ইউনূস যে সময়ে রাজনৈতিক দল করেন, সে সময়ে তার সঙ্গে আমার সাংবাদিক হিসেবে বেশ একটা জানাশোনা ছিল। এমনকি ওই সময়ে আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেখানে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের খবর ছাপানোর জন্যে তার ম্যানেজারদের আমার কাছেই পাঠাতেন, আমার ঊর্ধ্বতনদের কাছে নয়। তাছাড়া তিনি রাজনৈতিক দল করার সঙ্গে সঙ্গেই ওই দলের প্রচার ও জনগণের সঙ্গে সংযোগ গড়ার দায়িত্ব নেন তাঁর ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আমার দু’একজন অন্য বন্ধুবান্ধব বা বড় ভাই ভালো চোখে দেখতেন না। তবে এ ক্ষেত্রে আমি এম. আর. আখতার মুকুল ভাইয়ের কথা মানতাম। তিনি একজন প্রফেসরের নাম করে বলতেন, ওনাকে যদি ওইভাবে জীবন বাঁচানোর জন্যে মুজিবনগরে (ভারতে) না যেতে হতো, তাহলে উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে কথিকা পড়েছেন, তার থেকেও ভালো কথিকা পড়তেন পাকিস্তান রেডিও থেকে।

যাহোক, জাহাঙ্গীর ভাই ওই প্রচারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তাঁর প্রচারের অফিস ও আমার অফিস কাছাকাছি ছিল। তাছাড়া এর আগে থেকেই জাহাঙ্গীর ভাই নিয়মিত আমার অফিসে আসতেন, লিখতেন; তাই তিনি এই প্রচারের বিষয়ে আমার সঙ্গে দিনে অন্তত দুই-তিনবার করে কথা বলতেন।

পার্টির এই প্রচার কাজ শুরু হওয়ার পর জাহাঙ্গীর ভাই প্রথম প্রথম খুবই উত্তেজিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, কয়েকটি ডেডিকেটেড গ্রামীণ সেল ফোন ও কয়েকটি ই-মেইল এডড্রেস খোলা হয়েছিল—কারা কারা মুহাম্মদ ইউনূসের নাগরিক শক্তিতে যোগ দিতে চান, তা জানতে।

এক দিনে কয়েকশ’ ই-মেইল ও কয়েকশ’ এসএমএস আসার পর জাহাঙ্গীর ভাই খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বাস্তবে তিনি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে তাঁর ওই অর্থে কোনো ধারণা ছিল না। তাই সেই উত্তেজনা নিয়েই তিনি বিকেলে আমার অফিসে আসেন। এসে বলেন, তিনি বিশাল সাড়া পাচ্ছেন। আমি তাকে নিরাশ করিনি। তবে বলেছিলাম, দেখেন, ১৯৯৬-তে কাদের সিদ্দিকী ভাই আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নতুন দল করার আগে এ-রকম বেশ কিছু চিঠি পেয়ে, আর তাঁকে বেশ কয়েক নেতা কথা দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে যাবেন—এ নিয়ে তিনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। সে সব লোকরাও তার সঙ্গে আসেনি আর ওই নেতারাও আসেননি- এখন তো তাঁর একমাত্র গামছাই সম্বল।

জাহাঙ্গীর ভাই অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছিলেন, কাদের সিদ্দিকীর পার্টি করা আর ড. ইউনূসের পার্টি করা এক নয়। তাঁর সব কথার সারমর্ম ছিল—এটা কোনো মেঠো রাজনৈতিক দল নয়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তি এবং সরকারের ভেতরের শক্তি কাজ করবে। যাহোক, এ নিয়ে সেদিন দুজনের প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপ হয়। সদালাপী জাহাঙ্গীর ভাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিই।

এর পরে এক পর্যায়ে মুহাম্মদ ইউনূস পার্টি করা থেকে সরে আসেন। তাঁর সরে আসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওই সময়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। এবং কেন তিনি সরে এসেছিলেন—তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার কারণে আরেকটি ছবি পাই। যাক, সেসব এখন অতীত।

মুহাম্মদ ইউনূস সরে যাওয়ার পরে ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ভাই ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসেন। ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ভাই এই কিংস পার্টি করার আগে জার্মানির গ্রিন পার্টির শাখা বাংলাদেশে খোলার চেষ্টা করছিলেন। প্রেসক্লাবে তিনি হয়তো গ্রিন পার্টি নিয়ে কথা শোনার লোক কম পেতেন—আর তখনও যেহেতু আমি একটু-আধটু প্রেসক্লাবে যেতাম, তাই আমাকে পেলেই তিনি গ্রিন পার্টি নিয়ে আলাপ করতেন। আমিও তাঁর কাছ থেকে গ্রিন পার্টির অনেক লিটারেচার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। যাহোক, তিনিও কিংস পার্টি শুরু করলে আমাদের অফিসে এলে বেশি সময় আমার সঙ্গেই কাটাতেন।

তবে এক পর্যায়ে জানতে পারি, ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতি কিংস পার্টি তৈরির চেষ্টা থেকে সরে এসেছে। বরং ওই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে—বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে দ্রুত নির্বাচন করার জন্যে। এটা জানতে পেরে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের, আর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন যে রাজনীতিকরা, তাঁদের সঙ্গে লিংক রক্ষা করতে থাকি—সংবাদ ও দেশের রাজনীতির বাস্তবতা জানতে।

ওই উপদেষ্টাগণ অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং সে সময়ের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, আর তাঁদের সহযোগী প্রাক্তন সিএসপি অফিসাররা বড় মাপের যোগ্য মানুষ ছিলেন—তাই দেশ দ্রুত নির্বাচনের পথে আসে।

এই সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই বাংলাদেশের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি একটি জরিপ করে, আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি ও দেশীয় সহায়তায় আরেকটি জরিপ করান। ওই দুই জরিপের মূল অংশ যেকোনোভাবে হোক জোগাড় করতে সমর্থ হই। দুই জায়গার জরিপের ফল গড় করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫০ আসন ছাড়িয়ে যাবে।

নির্বাচনের সামান্য আগে এসে, অনেকটা কনজারভেটিভভাবে, “ বিশেষ প্রতিবেদক”  হিসেবে একটি রিপোর্ট লিখি যে, মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। এর পরে নির্বাচনের দিন মুন্সীগঞ্জের একটি আসন, ঢাকার কেরাণীগঞ্জ আসন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ আসন, সাভারের আশুলিয়া, আর ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মতিঝিল আসন ঘোরার সুযোগ পাই। কেরাণীগঞ্জের একটি প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছাই সকাল সাতটায়। দেখি—দীর্ঘ ভোটের লাইন তখনই দাঁড়িয়ে গেছে; ব্যস্ত নৌকার ও ধানের শীষের ব্যাজধারীরা।

বাংলাদেশ ও ভারত—এই দুই দেশে সবচেয়ে বেশি নির্বাচন কভার করেছি। দুই জায়গাতেই দেখেছি, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে নির্বাচনে আসনের হেরফের হয় অনেক বড় আকারে, তবে বিজয়ী ও পরাজিত দল বা জোটের মোট ভোটের শতকরা হারের হেরফের খুব বেশি থাকে না। এর মূল কারণ থাকে এক ধরনের ওয়েভ। আর এই দুই দেশের ভোটে উন্নয়ন বা গুড গভর্ন্যান্স খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। বরং আদভানীজী’র  কথাই সঠিক—“রুটি-মাখনায় এখানে ভোট হয় না”; বাস্তবে যেকোনো ওয়েভই ভোটের মাঠ দখল করে নেয়।

সাংবাদিক হিসেবে বাইরে থেকে যা দেখেছি এবং ভেতর থেকেও যত দূর দেখেছি, তাতে বলতে পারি—১/১১ সরকার প্রথম দিকে দু’বার কিংস পার্টি করার উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করতে চেয়েছিল। তারা সিভিল সোসাইটি ও তাদের সহযোগী মিডিয়াকে দিয়ে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরাতে চেয়েছিল। এমনকি মফস্বল থেকে এসে, মাত্র কয়েক বছর যাঁদের সাংবাদিকতার বয়স, তারাও লেখার মাধ্যমে দুই নেত্রীকে রাজনীতি ছেড়ে “চাঁদ দেখার নিমন্ত্রণ” করার মতো নীচুতা দেখিয়েছিল প্রথম প্রথম।

কিন্তু শেষ অবধি যে নির্বাচন হয়, তা—ওই সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী ৬-তারিখে মিডিয়ায় বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভালো নির্বাচনই ২০০৮-এর নির্বাচন। বাস্তবতাও তাই। ওই সময়ে যতটুকু খবর পেতাম, তাতে জোর দিয়ে বলতে পারি—ওই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এখনও বেঁচে আছেন, যারা ওই নির্বাচন শুধু নয়, দেশকে গণতান্ত্রিক ট্রেনে তোলার কাজের এ-টু-জেড বলতেও পারবেন।

আর আগেই উল্লেখ করেছি, ওই সরকার ও তার প্রক্রিয়ার সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ কত গভীর ছিল। তিনি কেন “জুলাই সনদ” বলে একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে এ নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইছেন, কেন “ষড়যন্ত্র” আখ্যা দিচ্ছেন, তা সত্যি পরিষ্কার নয়। তবে ভালো কোনো কিছুকে যখন মন্দ বলা হয়, তখন স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়—কোনো না কোনো মন্দকে ভালো হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করার একটা সূচনা এটা। এ সূচনা কি জাতির জন্যে ভালো হবে, না—একটি অশুভ সংকেত?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক; সম্পাদক, সারাক্ষণ; The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

ভারতে জার্মান কায়দায় রিসিন সন্ত্রাস হামলার প্রস্তুতির অভিযোগ

জুলাই সনদ, ১/১১-এর কিংস পার্টি, ২০০৮-এর নির্বাচনের গায়ে কালি দেওয়া

০৮:০০:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫

মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই সনদ ঘোষণা করেছেন, সেটা যে অধ্যাপক লিখেছেন তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও সুব্রত রায় চৌধুরীর (সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদসহ আরও অনেকের ইনপুট ছিল) লেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অনুকরণ করেছেন।

কিন্তু বেসিক পার্থক্যটা থেকে গেছে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও সুব্রত রায় চৌধুরী সবাই আইনজীবী—তাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতিটি শব্দে আইনগত দিকটি স্পষ্ট করা হয়েছে।

আর মুহাম্মদ ইউনূসকে যে অধ্যাপক লিখে দিয়েছেন, তিনি মোটেই আইনের মানুষ নন, তাই মূলত এখানে আইনের বিষয়গুলো মোটেই স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি বা অনুকরণ করা হয়নি। প্রকৃত অর্থে অনুকরণ করা হয়েছে মূলত দুটি শব্দ—“এবং” ও “যেহেতু”।

তাছাড়া যারা জুলাইয়ের আন্দোলনটি করেছিল বলে দাবি করে, তাদের বক্তব্যও কিন্তু পরিষ্কার নয়—তারা কি জুলাই সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সিস্টেমের পরিবর্তন চায়, না ভবিষ্যতে নিজেদের নিরাপত্তা বা বিচারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটা সাংবিধানিক গ্যারান্টি চায়। যে মেয়েটি সম্প্রতি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম; সে বলছিল, যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে—তাহলে হয় আমরা রাস্তায় মারা যাব, না হয় আমাদের বিচারিকভাবে মারা যেতে হবে।

তাই জুলাই সনদে তাদের এ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি বড় ছিল। তার জন্যে আইনগত একটা কাঠামো তৈরির চেষ্টা থাকবে—এমনটি অনেকে ভেবেছিলেন। কিন্তু এখানে বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে আইনগতভাবে এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। যেহেতু পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাই তাদের ভয়ের বিষয়টি আওয়ামী লীগ থেকে নয়, আইনের ভয়। কারণ, যখনই আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে এবং তারা মব-শক্তি হারিয়ে ফেলবে—তখন আইন তাদের কীভাবে সুরক্ষা দেবে?

বিষয়টি জটিল। কোন অর্থনীতির বা পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপকের পক্ষে এ গ্যারান্টি তৈরি করা কঠিন। আর আমাদের মতো সাংবাদিকদের পক্ষে ওই আইনের সাগরে ডুব দেওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। তবে তারপরেও বলা যায়—বিষয়টি জটিল। কারণ, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই ইনডেমনিটি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন ঘটনায়। এবারের এই পুলিশ হত্যার বিচার নিয়ে ইনডেমনিটি মোট চারবার দেওয়া হলো  এদেশে। তবে সংবিধানের অংশ করা হয়েছিল পঞ্চম সংশোধনীতে একটি মাত্র ইনডেমনিটিকে।

যাহোক, সাধারণ জ্ঞানে বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধ্যায় ও সংবিধানের ২৬(২) বজায় রেখে যে কোনো ইনডেমনিটি দিলে তা সংবিধানের গার্ডিয়ান বিচারবিভাগ বা সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেবে স্বাভাবিক নিয়মে। আর যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানের জেনেসিস (Genesis) স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের জেনেসিসকে পরিবর্তন করা যায় না—এ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর একটি রায়ও আছে। সেখানেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে জেনেসিস বা মাতৃজনন কোষ বলেই উল্লেখ করেছেন।

তাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেহেতু পরিবর্তন সম্ভব নয়, যেহেতু এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের জেনেসিস, তাই সংবিধানের মৌলিক অধ্যায় পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই। অর্থাৎ সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের যে মৌলিক অধিকার রক্ষা করা হয়েছে তা আইনত পরিবর্তন করার ক্ষমতা কেউ রাখে না। এবং সংবিধানের পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন বলতে সংবিধানের মৌলিক অধ্যায়ে হাত দেওয়া বোঝায় না। যাহোক, বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই এটা নির্বাচিত সংসদ ও বিচার বিভাগের বিষয়।

তবে জুলাই সনদে আরও অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে ২০০৮-এর নির্বাচনকে অনেকটা ষড়যন্ত্রমূলক ও সঠিক নির্বাচন নয় বলা হয়েছে।

২০০৭-এর ১/১১ সরকার ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে এসেছিল, না পরিস্থিতিই ওই সরকারকে আসতে বাধ্য করেছিল—এটা বড় প্রশ্ন। ওই বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখার আকার যেমন বড় হয়ে যাবে, তেমনি লেখাও ভিন্ন দিকে চলে যাবে।

তবে ১/১১-এর সরকার একটি ষড়যন্ত্রমূলক সরকার ছিল না; দেশকে একটি ভালো নির্বাচন দেওয়ার জন্যে গঠিত হয়েছিল—সেটা মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের থেকে ভালো জানেন। কারণ, ওই সময়ে ওই সরকারের সমর্থনে তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দল করেন। এবং কেন তিনি দল তৈরি করেছিলেন, কারা তাকে উৎসাহিত করেছিলেন—তার কিছু অংশ সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরও জানা। তবে ড. ইউনূস যে সময়ে রাজনৈতিক দল করেন, সে সময়ে তার সঙ্গে আমার সাংবাদিক হিসেবে বেশ একটা জানাশোনা ছিল। এমনকি ওই সময়ে আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেখানে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের খবর ছাপানোর জন্যে তার ম্যানেজারদের আমার কাছেই পাঠাতেন, আমার ঊর্ধ্বতনদের কাছে নয়। তাছাড়া তিনি রাজনৈতিক দল করার সঙ্গে সঙ্গেই ওই দলের প্রচার ও জনগণের সঙ্গে সংযোগ গড়ার দায়িত্ব নেন তাঁর ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আমার দু’একজন অন্য বন্ধুবান্ধব বা বড় ভাই ভালো চোখে দেখতেন না। তবে এ ক্ষেত্রে আমি এম. আর. আখতার মুকুল ভাইয়ের কথা মানতাম। তিনি একজন প্রফেসরের নাম করে বলতেন, ওনাকে যদি ওইভাবে জীবন বাঁচানোর জন্যে মুজিবনগরে (ভারতে) না যেতে হতো, তাহলে উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে কথিকা পড়েছেন, তার থেকেও ভালো কথিকা পড়তেন পাকিস্তান রেডিও থেকে।

যাহোক, জাহাঙ্গীর ভাই ওই প্রচারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তাঁর প্রচারের অফিস ও আমার অফিস কাছাকাছি ছিল। তাছাড়া এর আগে থেকেই জাহাঙ্গীর ভাই নিয়মিত আমার অফিসে আসতেন, লিখতেন; তাই তিনি এই প্রচারের বিষয়ে আমার সঙ্গে দিনে অন্তত দুই-তিনবার করে কথা বলতেন।

পার্টির এই প্রচার কাজ শুরু হওয়ার পর জাহাঙ্গীর ভাই প্রথম প্রথম খুবই উত্তেজিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, কয়েকটি ডেডিকেটেড গ্রামীণ সেল ফোন ও কয়েকটি ই-মেইল এডড্রেস খোলা হয়েছিল—কারা কারা মুহাম্মদ ইউনূসের নাগরিক শক্তিতে যোগ দিতে চান, তা জানতে।

এক দিনে কয়েকশ’ ই-মেইল ও কয়েকশ’ এসএমএস আসার পর জাহাঙ্গীর ভাই খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বাস্তবে তিনি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে তাঁর ওই অর্থে কোনো ধারণা ছিল না। তাই সেই উত্তেজনা নিয়েই তিনি বিকেলে আমার অফিসে আসেন। এসে বলেন, তিনি বিশাল সাড়া পাচ্ছেন। আমি তাকে নিরাশ করিনি। তবে বলেছিলাম, দেখেন, ১৯৯৬-তে কাদের সিদ্দিকী ভাই আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নতুন দল করার আগে এ-রকম বেশ কিছু চিঠি পেয়ে, আর তাঁকে বেশ কয়েক নেতা কথা দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে যাবেন—এ নিয়ে তিনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। সে সব লোকরাও তার সঙ্গে আসেনি আর ওই নেতারাও আসেননি- এখন তো তাঁর একমাত্র গামছাই সম্বল।

জাহাঙ্গীর ভাই অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছিলেন, কাদের সিদ্দিকীর পার্টি করা আর ড. ইউনূসের পার্টি করা এক নয়। তাঁর সব কথার সারমর্ম ছিল—এটা কোনো মেঠো রাজনৈতিক দল নয়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তি এবং সরকারের ভেতরের শক্তি কাজ করবে। যাহোক, এ নিয়ে সেদিন দুজনের প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপ হয়। সদালাপী জাহাঙ্গীর ভাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিই।

এর পরে এক পর্যায়ে মুহাম্মদ ইউনূস পার্টি করা থেকে সরে আসেন। তাঁর সরে আসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওই সময়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। এবং কেন তিনি সরে এসেছিলেন—তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার কারণে আরেকটি ছবি পাই। যাক, সেসব এখন অতীত।

মুহাম্মদ ইউনূস সরে যাওয়ার পরে ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ভাই ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসেন। ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ভাই এই কিংস পার্টি করার আগে জার্মানির গ্রিন পার্টির শাখা বাংলাদেশে খোলার চেষ্টা করছিলেন। প্রেসক্লাবে তিনি হয়তো গ্রিন পার্টি নিয়ে কথা শোনার লোক কম পেতেন—আর তখনও যেহেতু আমি একটু-আধটু প্রেসক্লাবে যেতাম, তাই আমাকে পেলেই তিনি গ্রিন পার্টি নিয়ে আলাপ করতেন। আমিও তাঁর কাছ থেকে গ্রিন পার্টির অনেক লিটারেচার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। যাহোক, তিনিও কিংস পার্টি শুরু করলে আমাদের অফিসে এলে বেশি সময় আমার সঙ্গেই কাটাতেন।

তবে এক পর্যায়ে জানতে পারি, ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতি কিংস পার্টি তৈরির চেষ্টা থেকে সরে এসেছে। বরং ওই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে—বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে দ্রুত নির্বাচন করার জন্যে। এটা জানতে পেরে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের, আর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন যে রাজনীতিকরা, তাঁদের সঙ্গে লিংক রক্ষা করতে থাকি—সংবাদ ও দেশের রাজনীতির বাস্তবতা জানতে।

ওই উপদেষ্টাগণ অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং সে সময়ের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, আর তাঁদের সহযোগী প্রাক্তন সিএসপি অফিসাররা বড় মাপের যোগ্য মানুষ ছিলেন—তাই দেশ দ্রুত নির্বাচনের পথে আসে।

এই সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই বাংলাদেশের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি একটি জরিপ করে, আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি ও দেশীয় সহায়তায় আরেকটি জরিপ করান। ওই দুই জরিপের মূল অংশ যেকোনোভাবে হোক জোগাড় করতে সমর্থ হই। দুই জায়গার জরিপের ফল গড় করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫০ আসন ছাড়িয়ে যাবে।

নির্বাচনের সামান্য আগে এসে, অনেকটা কনজারভেটিভভাবে, “ বিশেষ প্রতিবেদক”  হিসেবে একটি রিপোর্ট লিখি যে, মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। এর পরে নির্বাচনের দিন মুন্সীগঞ্জের একটি আসন, ঢাকার কেরাণীগঞ্জ আসন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ আসন, সাভারের আশুলিয়া, আর ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মতিঝিল আসন ঘোরার সুযোগ পাই। কেরাণীগঞ্জের একটি প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছাই সকাল সাতটায়। দেখি—দীর্ঘ ভোটের লাইন তখনই দাঁড়িয়ে গেছে; ব্যস্ত নৌকার ও ধানের শীষের ব্যাজধারীরা।

বাংলাদেশ ও ভারত—এই দুই দেশে সবচেয়ে বেশি নির্বাচন কভার করেছি। দুই জায়গাতেই দেখেছি, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে নির্বাচনে আসনের হেরফের হয় অনেক বড় আকারে, তবে বিজয়ী ও পরাজিত দল বা জোটের মোট ভোটের শতকরা হারের হেরফের খুব বেশি থাকে না। এর মূল কারণ থাকে এক ধরনের ওয়েভ। আর এই দুই দেশের ভোটে উন্নয়ন বা গুড গভর্ন্যান্স খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। বরং আদভানীজী’র  কথাই সঠিক—“রুটি-মাখনায় এখানে ভোট হয় না”; বাস্তবে যেকোনো ওয়েভই ভোটের মাঠ দখল করে নেয়।

সাংবাদিক হিসেবে বাইরে থেকে যা দেখেছি এবং ভেতর থেকেও যত দূর দেখেছি, তাতে বলতে পারি—১/১১ সরকার প্রথম দিকে দু’বার কিংস পার্টি করার উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করতে চেয়েছিল। তারা সিভিল সোসাইটি ও তাদের সহযোগী মিডিয়াকে দিয়ে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরাতে চেয়েছিল। এমনকি মফস্বল থেকে এসে, মাত্র কয়েক বছর যাঁদের সাংবাদিকতার বয়স, তারাও লেখার মাধ্যমে দুই নেত্রীকে রাজনীতি ছেড়ে “চাঁদ দেখার নিমন্ত্রণ” করার মতো নীচুতা দেখিয়েছিল প্রথম প্রথম।

কিন্তু শেষ অবধি যে নির্বাচন হয়, তা—ওই সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী ৬-তারিখে মিডিয়ায় বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভালো নির্বাচনই ২০০৮-এর নির্বাচন। বাস্তবতাও তাই। ওই সময়ে যতটুকু খবর পেতাম, তাতে জোর দিয়ে বলতে পারি—ওই সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এখনও বেঁচে আছেন, যারা ওই নির্বাচন শুধু নয়, দেশকে গণতান্ত্রিক ট্রেনে তোলার কাজের এ-টু-জেড বলতেও পারবেন।

আর আগেই উল্লেখ করেছি, ওই সরকার ও তার প্রক্রিয়ার সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ কত গভীর ছিল। তিনি কেন “জুলাই সনদ” বলে একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে এ নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইছেন, কেন “ষড়যন্ত্র” আখ্যা দিচ্ছেন, তা সত্যি পরিষ্কার নয়। তবে ভালো কোনো কিছুকে যখন মন্দ বলা হয়, তখন স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়—কোনো না কোনো মন্দকে ভালো হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করার একটা সূচনা এটা। এ সূচনা কি জাতির জন্যে ভালো হবে, না—একটি অশুভ সংকেত?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক; সম্পাদক, সারাক্ষণ; The Present World.