গত এক দশকে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও শিল্পায়নের বড় বড় প্রকল্প বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় উল্লেখযোগ্য গতি এনেছিল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্প দেশকে নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরে সরকার কোনো বড় নতুন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়নি। এই স্থবিরতা কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নয়, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলছে।
অর্থনৈতিক সংকট ও বাজেট ঘাটতি
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ঋণ পরিশোধের চাপ এবং ডলার সংকটের কারণে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো বাজেট বরাদ্দ সম্ভব হয়নি। চলমান প্রকল্পগুলোতেও অর্থ ঘাটতির কারণে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। বাজেটের বড় অংশ ভর্তুকি, ঋণ পরিশোধ ও দৈনন্দিন খরচে ব্যয় হওয়ায় উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বাজেট ঘাটতি এখন সরকারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিশ্চিত না হলে বড় প্রকল্প নেওয়া সম্ভব নয়। চলমান প্রকল্পের জন্যও অর্থ জোগাড়ে সমস্যা হচ্ছে।”

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতিগত অনিশ্চয়তা
নির্বাচনী বছর এবং সরকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের মধ্যে আস্থা সংকট দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ ও প্রকল্প পরিকল্পনায় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ফলে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অনেক সংস্থা নতুন অর্থায়ন অনুমোদনে সতর্কতা নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নুরুল আমিন বলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বড় বিনিয়োগের পথে সবসময় বাধা। নীতি হঠাৎ বদলে যেতে পারে এমন পরিবেশে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চান না।”
বৈদেশিক ঋণ ও শর্তযুক্ত অর্থায়ন
গত এক দশকে নেওয়া বড় বিদেশি ঋণ এখন কিস্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে নতুন প্রকল্পের জন্য ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা প্রকল্প অনুমোদনের আগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আর্থিক সংস্কারের কঠোর শর্ত দিচ্ছে, যা দ্রুত পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ না করলে বড় অঙ্কের অর্থ পাওয়া যাবে না, আর এই শর্তগুলো এক বছরে পূরণ করা কঠিন।”

বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও আমদানি সীমাবদ্ধতা
বড় প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও প্রযুক্তি আমদানি-নির্ভর। কিন্তু ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকার আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে, যা নতুন প্রকল্প শুরু ও চলমান প্রকল্পের অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। বিদেশি পেমেন্ট আটকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক রাশেদুল করিম বলেন, “শুধু অর্থ থাকলেই হবে না—প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সময়মতো না এলে প্রকল্প থমকে যাবে।”
অগ্রাধিকার পরিবর্তন ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা
সরকার গত এক বছরে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক সাবেক সদস্য বলেন, “তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকে বড় প্রকল্পের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া স্বল্পমেয়াদে যুক্তিসঙ্গত হলেও দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন ব্যাহত করবে।”

দক্ষ জনবল ও প্রশাসনিক জটিলতা
প্রকল্প অনুমোদন, টেন্ডার প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের অভাব এবং প্রশাসনিক জটিলতা বড় প্রকল্প শুরুর পথে প্রধান বাধা। অনেক প্রস্তাবিত প্রকল্প বছরের পর বছর অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে।
প্রশাসনিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ ড. শামীম আহমেদ বলেন, “আমাদের অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। দ্রুত সিদ্ধান্ত ও কার্যকর মনিটরিং ছাড়া বড় প্রকল্প শুরু সম্ভব নয়।”
প্রভাব: উন্নয়নের গতি কমে যাওয়া
বড় প্রকল্পের অভাবে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো উন্নয়নের গতি কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় অনাগ্রহ দেখাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উন্নয়ন ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গত এক বছরে বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প না নেওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ঋণের চাপ ও আমদানি সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় সতর্ক হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের গতি ফেরাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















