জন্ম ও শৈশব
১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের মুন্সিপাড়ায় মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষ দত্ত। পৈতৃক নিবাস ছিল বগুড়া অঞ্চলে। ছোটবেলা থেকেই আঁকা-আঁকি ও মঞ্চশিল্পে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে চলচ্চিত্রপূর্ব প্রচারকাজ ও বাণিজ্যিক শিল্পে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের নন্দনশৈলী, পোস্টার নকশা ও শিল্প-নির্দেশনায় পারদর্শী হন। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে ঢাকায় একটি প্রচার সংস্থায় যোগ দিয়ে দেশের প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পোস্টার আঁকেন। এই কাজ তাঁকে চলচ্চিত্রশিল্পের মূলধারায় নিয়ে আসে।
পোস্টার আর্ট থেকে শিল্প–নির্দেশনা
পোস্টার শিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জনের পর তিনি সরাসরি চলচ্চিত্র ইউনিটে কাজ শেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রে আর্ট ডিরেকশন করে সেট ডিজাইন, শট বিন্যাস ও লোকেশনের নান্দনিকতা নিয়ে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা তাঁর পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করে।
অভিনয়ে যাত্রা
অভিনয়ের শুরু হয় এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ (১৯৫৯) ছবিতে খল-কমেডি চরিত্রে। এরপর মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ (১৯৬১)-এ কৌতুকাভিনয়ে দারুণ সাড়া ফেলেন। ছবিটি টানা পঁচিশ সপ্তাহ চলেছিল, যা তাঁকে অভিনয়ে জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
সত্যজিৎ প্রভাব ও ‘দত্তজিত’ উপাধি
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ভাষা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সহকর্মীরা স্নেহভরে তাঁকে ‘দত্তজিত’ বলে ডাকতেন। পোস্টার শিল্প, শিল্প-নির্দেশনা ও অভিনয়ের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি পরিচালনায় আসেন।
প্রথম পরিচালনায় সাফল্য
১৯৬৩ সালে কবরীকে নিয়ে ‘সুতরাং’ নির্মাণ শুরু করে ১৯৬৪ সালে মুক্তি দেন। এটি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয় এবং কবরীর নায়িকা হিসেবে অভিষেক ঘটে। দত্ত নিজেও নায়ক-পরিচালক হিসেবে সাফল্য পান। ১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট এশিয়া ফিল্ম উৎসবে ছবিটি দ্বিতীয় পুরস্কার পায়।
ধারাবাহিক চলচ্চিত্র নির্মাণ
‘সুতরাং’-এর পর তিনি একের পর এক সামাজিক ও মানবিক বিষয়ভিত্তিক ছবি নির্মাণ করেন—‘কাগজের নৌকা’ (১৯৬৬), ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৬–৬৭), ‘আবির্ভাব’ (১৯৬৮), ‘পালাবদল’ ও ‘আলিঙ্গন’ (১৯৬৯), এবং ‘বিনিময়’ (১৯৭০)। প্রতিটি ছবিতে নতুন মুখের আবিষ্কার, কাহিনির বৈচিত্র্য ও নির্মাণশৈলীর স্বকীয়তা ছিল লক্ষ্যণীয়।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নির্মাণ
১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৭২ সালে তিনি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ নির্মাণ করেন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের অভ্যুদয়, যুদ্ধোত্তর মানসিক আঘাত ও সামাজিক পুনর্গঠন উঠে আসে।
জাতীয় স্বীকৃতি
১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ নির্মাণ করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পরিচালকসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কার জেতেন।
আশি–নব্বই দশকের কাজ
‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮), ‘সবুজসাথী’ (১৯৮২), ‘নাজমা’ (১৯৮৩), ‘সকাল-সন্ধ্যা’ (১৯৮৪), ‘স্বামী-স্ত্রী’ (১৯৮৭) প্রভৃতি ছবিতে পারিবারিক মনস্তত্ত্ব, নারী অভিজ্ঞতা, শ্রেণি বৈষম্য ও নৈতিক দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলেন।
শেষ চলচ্চিত্র ও প্রস্থান
দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৮ সালে ‘ও আমার ছেলে’ নির্মাণ করে পারিবারিক নৈতিক সংকট নিয়ে সমসাময়িক প্রজন্মকে ভাবতে আহ্বান জানান। এটি ছিল তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সুভাষ দত্ত কর্মজীবনে একুশে পদক (১৯৯৯), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭, ‘বসুন্ধরা’), নিগার অ্যাওয়ার্ড (১৯৬২, কৌতুক অভিনয়ের জন্য) অর্জন করেন। এছাড়া মস্কো, ফনম পেন ও ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একাধিক পুরস্কার লাভ করেন।
চলচ্চিত্র ভাষা ও নান্দনিকতা
তাঁর সিনেমায় গ্রামীণ-নগর জীবনের দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্তের নৈতিক সংকট ও নারীর অন্তর্গত যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। সেট ডিজাইন, প্রপস ও লোকেশন ব্যবহারে তিনি ছিলেন সাহসী ও দক্ষ। সঙ্গীতের মাধ্যমে গল্পকে গভীরতা দিতেন।
নতুন মুখ আবিষ্কার
বাংলা চলচ্চিত্রে কবরীকে নায়িকা ও উজ্জ্বলকে নায়ক হিসেবে প্রথম সুযোগ দেন তিনি। পোস্টার শিল্পেও তাঁর নিজস্ব ধারা ছিল, যা ঢাকার বহু চলচ্চিত্রের প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
ব্যক্তিজীবন
স্ত্রী সীমা দত্তের মৃত্যুর পর (২০০১) তিনি দুই ছেলে শিবাজী ও রানাজী এবং দুই মেয়ে শিল্পী ও শতাব্দীকে রেখে যান। জীবনের শেষভাগে হৃদরোগে ভুগলেও চলচ্চিত্রজগতে সক্রিয় ছিলেন।
নির্বাচিত চলচ্চিত্র (পরিচালনা)
সুতরাং (১৯৬৪), কাগজের নৌকা (১৯৬৬), আয়না ও অবশিষ্ট (১৯৬৬–৬৭), আবির্ভাব (১৯৬৮), আলিঙ্গন (১৯৬৯), পালাবদল (১৯৬৯), বিনিময় (১৯৭০), অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২), আকাঙ্ক্ষা (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭), ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), সবুজসাথী (১৯৮২), নাজমা (১৯৮৩), সকাল-সন্ধ্যা (১৯৮৪), স্বামী-স্ত্রী (১৯৮৭), ও আমার ছেলে (২০০৮)।
উত্তরাধিকার
সুভাষ দত্ত পোস্টার শিল্পী, শিল্প-নির্দেশক, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে লোকেশন বাস্তবতা, সংযত অভিনয় ও মিতব্যয়ী গল্প বলার মাধ্যমে বাংলা সিনেমা আন্তর্জাতিক দর্শকদের মন জয় করতে পারে। তাঁর কাজ নতুন প্রজন্মের জন্য এক শিক্ষালয়—যেখানে চরিত্র নির্মাণ, দৃশ্য বিন্যাস, কাহিনির গতি ও মানবিক অনুভূতির পাঠ রয়েছে।
সময়রেখা
১৯৫৩—ঢাকায় প্রচার সংস্থায় যোগদান, পোস্টার শিল্পে পদার্পণ।
১৯৫৬—‘মুখ ও মুখোশ’ ছবির পোস্টার আঁকা।
১৯৫৯—‘মাটির পাহাড়’ (শিল্প-নির্দেশনা) ও ‘এ দেশ তোমার আমার’ (অভিনয়)।
১৯৬১—‘হারানো দিন’ মুক্তি, টানা পঁচিশ সপ্তাহ প্রদর্শিত।
১৯৬৪—‘সুতরাং’ দিয়ে পরিচালনায় অভিষেক, আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন।
১৯৬৬–১৯৭০—‘কাগজের নৌকা’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘আবির্ভাব’, ‘বিনিময়’।
১৯৭২—‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ মুক্তি।
১৯৭৭—‘বসুন্ধরা’ মুক্তি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছয় বিভাগে জয়।
১৯৯৯—একুশে পদক লাভ।
২০০৮—‘ও আমার ছেলে’ মুক্তি।
২০১২—প্রয়াণ।