নতুন মহামারীর আশঙ্কা
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক মালিক পেইরিস সতর্ক করেছেন যে পরবর্তী মহামারী অনিবার্য, এবং বিশ্ব হয়তো এখনো প্রস্তুত নয়। তার মতে, ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলায় মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস শনাক্তকারী বিজ্ঞানী পেইরিস বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস নিয়ে। তার মতে, এসব ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিশ্বে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ
পেইরিস বলেন, সাম্প্রতিক কয়েক দশকে প্রাণী ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার প্রবণতা বেড়েছে। প্রায় তিন থেকে চার বছর অন্তর নতুন ভাইরাস দেখা দিচ্ছে—যেমন সার্স, সোয়াইন ফ্লু, কোভিড-১৯, মার্স, ইবোলা ও জিকা।
তিনি উল্লেখ করেন, নিবিড় পশুপালন, বৈশ্বিক ভ্রমণের বৃদ্ধি এবং পোষা প্রাণীর বাণিজ্য এসব ভাইরাসকে আরও দ্রুত ছড়াতে সাহায্য করছে। মুরগির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনের জন্য যেসব ব্রয়লার মুরগি লালন করা হয়, তারা প্রায় একই জিনগত বৈশিষ্ট্যের। ফলে একটি ভাইরাস ঢুকতে পারলে তা পুরো প্রজাতির মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভ্রমণ ও পোষা প্রাণীর ঝুঁকি
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান প্রাণীর মাধ্যমে এমপক্স ছড়িয়ে পড়া এবং ২০২২ সালে হংকং-এ হ্যামস্টারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ পোষা প্রাণীর বাণিজ্যের ঝুঁকি স্পষ্ট করে।
একইভাবে, আধুনিক ভ্রমণের সুবিধা মানুষকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যায়। এতে উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাস অন্য দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে।
কোন ভাইরাস সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ?
পেইরিসের মতে, ইনফ্লুয়েঞ্জা, করোনাভাইরাস ও মার্সের মতো শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস সবচেয়ে বড় হুমকি। অন্যদিকে মশাবাহিত বা সংস্পর্শে ছড়ানো ভাইরাস যেমন ইবোলা তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে নতুন ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।
প্রস্তুতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা
তিনি মনে করেন, মহামারী মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা অপরিহার্য। ২০০৩ সালের সার্স মহামারীতে সমন্বিত পদক্ষেপ এর প্রমাণ দেয়। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ভাইরাস শনাক্তকরণ, টিকা ও চিকিৎসার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক সমন্বয় ছাড়া কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
তবে টিকা বিরোধিতা, মাস্ক ব্যবহারে অনীহা এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর মতো সামাজিক চ্যালেঞ্জ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
গবেষণা ও আবিষ্কার
পেইরিস ১৯৯৫ সালে হংকং-এ আসার পর কুইন মেরি হাসপাতালে ভাইরোলজি ল্যাব স্থাপন করেন। ২০০৩ সালে সার্স দেখা দিলে তার দল দ্রুত একটি নজরদারি ব্যবস্থা চালু করে। অবশেষে তারা নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত করে, যা সার্স-কোভ-১ নামে পরিচিত হয়।
পরে গবেষণায় দেখা যায়, বাদুড় ছিল ভাইরাসটির মূল উৎস, যা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমে বাজারে এসে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। একই পথ ধরে সার্স-কোভ-২ মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হয়।
কোভিড-১৯ অভিজ্ঞতা
সার্স-কোভ-২ ছিল আরও জটিল, কারণ এটি উপসর্গ প্রকাশের আগেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। ২০২০ সালের শুরুতেই এর জিনগত তথ্য প্রকাশিত হলে বোঝা যায় এটি বাদুড়-সংশ্লিষ্ট ভাইরাস। উহানের সামুদ্রিক খাবারের বাজারকেই সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
‘ওয়ান হেলথ’ ধারণা
পেইরিস বলেন, মহামারী প্রতিরোধে ‘ওয়ান হেলথ’ বা যৌথ স্বাস্থ্য পদ্ধতি অনুসরণ জরুরি। এতে মানবস্বাস্থ্য, প্রাণীস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
তিনি উদাহরণ দেন—চীনে ২০১৩ সালের এইচ৭এন৯ বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে মুরগির টিকা ব্যবহার করে মানুষের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। একইভাবে, হংকং-এ ১৯৯৭ সাল থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি গ্রহণের ফলে স্থানীয়ভাবে এইচ৫এন১ ও এইচ৭এন৯ সংক্রমণ ঠেকানো গেছে।
পেইরিসের মতে, প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি শনাক্ত করে সময়মতো পদক্ষেপ নিলে মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। তার মতে, মহামারী ঠেকাতে প্রমাণভিত্তিক গবেষণা, বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপ এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা ছাড়া বিকল্প নেই।
কোভিড পরবর্তী আরেকটি মহামারী অনিবার্য, সতর্ক করলেন হংকং-এর শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট
- ০৪:১২:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫
- 44
জনপ্রিয় সংবাদ