১৪–১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর মধ্যরাতে ভারতীয় উপমহাদেশ—নদী ও সাম্রাজ্যের, কবি ও তীর্থযাত্রীর এক বহুযুগের সভ্যতা—দুইটি নতুন রাষ্ট্রে বিভক্ত হলো। স্বাধীনতাকে উদ্যাপনের যে রূপকল্প ছিল, তা পরিণত হলো মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও রক্তক্ষয়ী বিপর্যয়ে। শতাব্দী-প্রাচীন সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাসের বোনা আখ্যান তড়িঘড়ি আঁকা সীমারেখায় ছিঁড়ে গেল—যার দাগ আজও গভীর।
মাউন্টব্যাটেনের পরীক্ষাগার: ইতিহাসকে ত্বরান্বিত করা
ব্রিটিশ শাসনের শেষ প্রহরে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাম্রাজ্যের ক্লান্তি এবং তড়িঘড়ি কূটনীতি মিলিত হলো ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিত্বে। লবিং ও সাম্রাজ্যিক হিসাব-নিকাশের ফলে তাঁর দ্রুত নিয়োগ এমন সব সিদ্ধান্তকে গতিশীল করল, যেগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছে।
জওহরলাল নেহরু ও ভাইসরয়েন এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে—কারও কারও কাছে যা গভীরতর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রতীক। সত্য হোক বা কল্পনা, এই ধারণাই পরে পাকিস্তানে “স্যাটানিক অ্যাফেয়ার” নামে পরিচিত হয়—একটি উপমা, যা এমন এক নিয়তির শৃঙ্খলকে বোঝায়, যার প্রভাব আজও প্রায় দুইশ’ কোটি মানুষের ভাগ্যে কাজ করছে।
মার্চ ১৯৪৭-এ মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয়ের দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি গৃহযুদ্ধসন্নিহিত একটি দেশ পান। তাঁর পূর্বসূরি লর্ড ওয়েভেল ‘ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা’—বিভক্তি এড়াতে একটি যুক্তভারত—নিয়ে কাজ করলেও বেঙ্গল ও পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ততক্ষণে সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল।
মাউন্টব্যাটেনের মূল ম্যান্ডেট ছিল ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর। অথচ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সময়সীমা দশ মাস এগিয়ে আনেন—এই আশঙ্কায় যে দীর্ঘায়িত অস্থিরতা উপমহাদেশকে নিয়ন্ত্রণহীন সহিংসতায় ঠেলে দেবে। সমালোচকদের মতে, এই তাড়াহুড়ো নিরাপদ অভিবাসন, কার্যকর পুলিশিং এবং সুষ্ঠু সীমা-নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় রাখেনি।
সীমারেখা টানার দায় পড়ে ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের ওপর—যিনি এর আগে কখনো ভারতে যাননি। তাঁকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দিয়ে যে রেখা টানা হলো—র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড—তা গ্রাম, পরিবার ও কৃষিজমি কেটে গেছে। পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি মুসলিম-অধ্যুষিত তহসিল ভারতে দেওয়া এবং জম্মু–কাশ্মীরের প্রশ্ন অনির্ধারিত রাখা—পরবর্তী কয়েক দশকের সংঘাতের বীজ বপন করে।

নেহরু–এডউইনা সম্পর্ক: রাজনীতি, নাকি ধারণা?
নেহরু ও এডউইনার কথিত রোমান্টিক বন্ধন দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত কাহিনি। পামেলা হিক্সের ‘ডটার অব এম্পায়ার’-এ প্রকাশিত তাঁদের চিঠিপত্রে গভীর অনুরাগ ও বৌদ্ধিক সখ্যতার ইঙ্গিত মেলে। ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স ভন টুনজেলমান ‘ইন্ডিয়ান সামার’-এ আবেগীয় ঘনিষ্ঠতার কথা বললেও শারীরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত প্রমাণ পান না।
তবু ১৯৪৭-এর টানটান রাজনৈতিক পরিবেশে ধারণাই ছিল বাস্তবের সমান প্রভাবশালী। পাকিস্তানে অনেকের চোখে এই বন্ধুত্ব র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডে মাউন্টব্যাটেনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে—বিশেষত সীমা-নির্ধারণে। সত্য যাই হোক, দৃশ্যমানতার এই রাজনীতি ছিল ক্ষতিকর, আর নেহরুর ভাইসরয়েনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের অনুকূলে সীমা বদলে দিয়েছে—এ বিশ্বাস জাতীয় স্মৃতিতে গেঁথে যায়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা—বিশেষ করে নেহরু ও প্যাটেল—পাকিস্তানের দৃষ্টিতে ছিলেন কঠোর, আত্মবিশ্বাসী ও আপসহীন।
জিন্নাহর অসম্মতি ও ভিন্ন পথে যাত্রা
মুসলিম লীগের নেতা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নতুন রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল হিসেবে মাউন্টব্যাটেনকে মানতে অস্বীকৃতি জানান—একে তিনি সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেন। এই সিদ্ধান্তই প্রথম দিন থেকে ভারত–পাকিস্তানকে পৃথক, প্রায়শই বৈরী, গতিপথে ঠেলে দেয়।
অন্যদিকে, নেহরু স্বাধীনতার পর আরও দশ মাস মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে রাখেন—পাকিস্তানে যাকে অনেকে ‘রাজনৈতিক ঘুষ’ দেখলেও, অন্যরা এটিকে বাস্তববুদ্ধির পদক্ষেপ বলে মনে করেন।
বিভাজন উন্মোচন করল অকল্পনীয় মানবিক ট্র্যাজেডি। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণ-অভিবাসনে ১ থেকে দেড় কোটি মানুষ ছিন্নমূল হয়। লাশভর্তি ট্রেন এসে পৌঁছাত; সম্পূর্ণ কাফেলা নিখোঁজ হয়ে যেত। নিহতের সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখ থেকে ১০ লাখেরও বেশি। নারীরাই সবচেয়ে বেশি আঘাত পান—দশ হাজারেরও বেশি নারী অপহৃত, ধর্ষণের শিকার বা ‘সম্মান’ রক্ষার নামে নিহত হন।
ইচ্ছামতো টানা সীমারেখা কাশ্মীরকে করে তোলে বারুদের স্তূপ—শুরু হয় প্রথম ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭–৪৮), যা পরবর্তী সংঘাতগুলোর ভিত্তি তৈরি করে: ১৯৬৫, ১৯৭১, সিয়াচেন, ১৯৯৯-এর কারগিল এবং অগণিত সীমান্তসংঘর্ষ।

গান্ধীর শেষ লড়াই
মহাত্মা গান্ধী বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরোধিতা করে শেষ মাসগুলো উপবাস, মধ্যস্থতা এবং পাকিস্তানের পাওনা অর্থ মেটাতে ভারতের বাধ্যবাধকতা স্মরণ করিয়ে কাটান। নেহরু মন্ত্রিসভাকে রাজি করিয়ে পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি রুপি ছাড়ানোর পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি নাথুরাম গডসে-র হাতে নিহত হন—একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী, যিনি তাঁকে দেশদ্রোহী মনে করতেন। গান্ধীর মৃত্যু পুনর্মিলনের শেষ বড় স্বরগুলোর একটি স্তব্ধ করে দেয়।
শীতল যুদ্ধ থেকে শীতল শান্তি
বিভাজনের পরবর্তী দশকে ভারত–পাকিস্তানের বৈরিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। কাশ্মীর অনির্ধারিতই থাকে; ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি সত্ত্বেও নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ চলতে থাকে; শীতল যুদ্ধের জোট-রাজনীতি অবিশ্বাস গভীর করে।
অর্থনৈতিকভাবে ক্ষুদ্র ও দুর্বল পাকিস্তান তার বাজেটের ২০ শতাংশেরও বেশি প্রতিরক্ষায় ব্যয় করে—ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতও সামরিক ব্যয় বাড়ায়; শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালে উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে।
গণতন্ত্রের শৃঙ্খল
দুটি দেশই সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে শুরু করলেও স্বৈরতান্ত্রিক অধ্যায় বারবার ফিরে এসেছে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা (১৯৭৫–৭৭) নাগরিক অধিকার স্থগিত করে; ২০১৯ সালে মোদি সরকার ধারা ৩৭০ বাতিল করে জম্মু–কাশ্মীরের সাংবিধানিক অবস্থান বদলে দেয়—যা অনেকের চোখে দমনমূলক পদক্ষেপ। পাকিস্তান বারবার সামরিক অভ্যুত্থান (১৯৫৮, ১৯৭৭, ১৯৯৯) দেখেছে; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত এবং বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিককরণের অভিযোগ তীব্র হয়েছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যও প্রবল: পাকিস্তানের গ্রামে প্রায় অর্ধেক এবং ভারতের গ্রামে প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ নিজ নিজ দারিদ্র্যসীমার নিচে; স্বাস্থ্যসেবা ও সাক্ষরতা—বিশেষত নারীশিক্ষা—এখনও পিছিয়ে।

প্রবাস ও হারানো স্বপ্ন
উভয় দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও উপসাগরীয় অঞ্চলে বসবাস করেন। একদা লাহোর, দিল্লি, করাচি ও কলকাতা ছিল সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের বিশ্বনাগরিক কেন্দ্র। আজ দশকের পর দশক বৈরিতায় সে আদান-প্রদান বিরল। দুই দেশের তরুণেরা ক্রমেই সুযোগের খোঁজে বিদেশমুখী—পিছনে ফেলে যাচ্ছেন ইতিহাসসমৃদ্ধ, সহযোগিতায় অনাহারী এক অঞ্চল।
বৌদ্ধিক সংহতির আহ্বান
“স্যাটানিক অ্যাফেয়ার” শুধু নেহরু–এডউইনা প্রসঙ্গ নয়। এটি তিক্ত সেই সত্যের প্রতীক—যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত এবং সাম্রাজ্যের দায় এড়ানো মিলিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদি ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করেছে। ‘সফল’ ডিকলোনাইজেশন উদ্যাপন করলেও ব্রিটেন খুব কমই স্বীকার করে—তারা কী ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় রেখে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এখন প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ, লেখক ও নাগরিক নেতাদের একসঙ্গে কথা বলতে হবে—অতীতের অন্যায় স্বীকারে, ঘৃণার রাজনীতির প্রতিরোধে, এবং জাতীয় শক্তিকে মানবউন্নয়নের দিকে ঘুরিয়ে দিতে।
স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরও উপমহাদেশের মানুষ ভাষা, রান্না ও সঙ্গীত ভাগ করে—তবু অবিশ্বাসে বিভক্ত। “স্যাটানিক অ্যাফেয়ার”-এর শিক্ষা হলো—ব্যক্তিগত অবিশ্বাস যেমন বিধ্বংসী, রাজনৈতিক সংঘাতও তেমন; আর গোপনীয়তা ও তাড়াহুড়ো প্রকাশ্য শত্রুতার চেয়েও গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে।
সমঝোতা কেবল সরকার থেকে আসবে না। তা গড়ে তুলতে হবে মানুষের হাতে—সীমান্ত, ধর্ম ও প্রজন্ম পেরিয়ে—একজন আরেকজনকে শত্রু নয়, বরং এক যৌথ, ক্ষতবিক্ষত, তবু সুন্দর সভ্যতার সহ-উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখার মধ্য দিয়ে। উপমহাদেশের সকল জাতিকেই শিখতে হবে—ভালো প্রতিবেশী হয়ে থাকা।
দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে সমতার ওপর—আর তার চাবিকাঠি রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে।
লেখকঃ বিশিষ্ট সম্পাদক, থিমট্যাক ও গবেষক।
মোবাশ্বির মীর 


















