খনির প্রলোভন থেকে চাষাবাদে ফেরা
ইন্দোনেশিয়ার সিতোরেক কিদুল অঞ্চলের কৃষক দেদি সুপ্রিয়াদি একসময় পাহাড় খুঁড়ে সোনা তুলতেন। কিন্তু এখন তিনি তার জমিতে বেগুন ও শসা চাষ করছেন। পাহাড়ি এলাকা জুড়ে অবৈধ সোনা খননের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। অ্যান্টাম নামের একটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি খনি ছেড়ে দেওয়ার পর স্থানীয় মানুষজন অর্থনৈতিক চাপে পড়ে সোনা অনুসন্ধানে নামে।
তবে এই প্রক্রিয়ায় বন ধ্বংস হচ্ছে, পারদ ও সায়ানাইডের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে নদী দূষিত হচ্ছে এবং বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে।
পুলিশের দমন ও পরিবর্তনের আশা
অভিযোগ রয়েছে, এসব অবৈধ খনি পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি প্রাণঘাতী ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা সুকমাদি জয়া রুকমানা সতর্ক করে বলেছেন, পাহাড়ের সবুজ উদ্ভিদ কেটে ফেলা হলে বৃষ্টির পানি সরাসরি নেমে এসে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
ফলে কিছু খনি শ্রমিক কৃষিকাজে ফিরতে শুরু করেছেন। সুপ্রিয়াদি বলেন, বর্ষায় পাহাড় ধসে চাপা পড়ার ভয় তাকে খনি ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে। তার ভাষায়, “খনিতে কাজ করার চেয়ে ক্ষুদ্র চাষাবাদ অনেক নিরাপদ ও স্থায়ী।”
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংকট
সিতোরেক কিদুলের প্রায় ১,৮০০ মানুষ কাসেপুহান বানতেন কিদুল আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিতে বসবাস করে। এই সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবে পবিত্র বন সংরক্ষণ ও ধানকেন্দ্রিক সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। কিন্তু সোনা উত্তোলনের ফলে গভীর গর্ত ও সুরঙ্গ তৈরি হয়েছে, যা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।
বৈশ্বিক স্বর্ণ উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব স্বর্ণ উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশ যোগান দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ও পেরুর পাশাপাশি দেশটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকারী। ১৯৮০-এর দশকে অ্যান্টাম কোম্পানি সিতোরেক কিদুল এলাকায় খনি চালু করেছিল, যা ১৯৯০-এর দশকে বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানি চলে যাওয়ার পর স্থানীয়রা অযাচিতভাবে পুরোনো খনিগুলো ব্যবহার করতে শুরু করে।
ফলস্বরূপ, অবৈধ খনি দ্রুত বাড়তে থাকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বান্তেন আঞ্চলিক পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ খনি খোলার অভিযোগ রয়েছে। এর শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০০ বিলিয়ন রুপিয়া, যা প্রায় ৬.১ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ জরিমানা।
সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আইনি দুর্বলতা
আদিবাসী কাউন্সিল প্রধান জাজাং কুরনিয়াওয়ান বলেন, এই অঞ্চলের মানুষের কৃষি ও মৎস্যচাষের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, কিন্তু খনির কোনো প্রথা ছিল না। তিনি জানান, বড় কোম্পানির মাধ্যমে খনি শুরু হওয়ার পর থেকেই সমস্যার উৎপত্তি।
তিনি স্বীকার করেন, “মানুষ খনিকে জীবিকার অংশ হিসেবে নিয়েছে। সরাসরি নিষিদ্ধ করলে নিজেদের লোকজনের সঙ্গেই সংঘাত বাঁধবে।”
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মানবিক ক্ষতি
স্থানীয় শ্রমিক সুমন্ত্রি জানান, তিনি প্রতিদিন ১৫০ মিটার গভীরে নেমে সোনা খোঁজেন, সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই। গুহার ভেতরে ভেঙে পড়ার ঝুঁকি সবসময় থাকে। কাঠ দিয়ে দেয়াল শক্ত করতে হয়।
সুপ্রিয়াদি স্মরণ করেন, একসময় ১৫ জনের দল নিয়ে বিস্ফোরক ব্যবহার করে গুহার ভেতর থেকে পাথর তুলতেন। শ্বাস নেওয়ার জন্য প্লাস্টিক পাইপে মেশিন থেকে বাতাস ঢুকানো হতো। কিন্তু ধুলা ও যন্ত্রের দূষিত বাতাসে অনেকেই যক্ষ্মা ও ফুসফুসের সমস্যায় ভুগেছেন।
কৃষির মাধ্যমে বিকল্প সমাধান
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইন্দোনেশিয়া খনি কমাতে চায়, তবে বিকল্প জীবিকা যেমন কৃষি, মৎস্যচাষ ও উদ্ভিদনির্ভর উদ্যোগকে শক্তিশালী করতে হবে।
ইন্দোনেশিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর সাসটেইনেবল মাইনিং-এর প্রধান রেজকি স্যাহরির বলেন, “অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। কৃষি, প্ল্যানটেশন কিংবা মৎস্যচাষের মাধ্যমে আয় সৃষ্টি করা সম্ভব।”
তবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী ধানকে পবিত্র মনে করা হয় এবং তা বাজারে বিক্রি করা যায় না। ফলে নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে।
নতুন জীবনের আশা
রুকমানা জানান, সম্প্রতি ১০ জন অবৈধ খনি শ্রমিক কৃষিকাজে ফিরেছেন। তারা সবজি উৎপাদন করে স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবেন।
সুপ্রিয়াদি ২০১৬ সালে খনি ছেড়ে আসেন। বর্তমানে তিনি কৃষির পাশাপাশি মোটরসাইকেল মেরামতের দোকান চালান। তার ভাষায়, “সোনার খনি শুধু শরীর ভেঙে দেয়। চাষাবাদ আমাকে স্থায়ী আয়ের পাশাপাশি নিরাপত্তাও দিয়েছে।”
এই পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে অবৈধ স্বর্ণখনির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে কৃষি ও ঐতিহ্যনির্ভর জীবনে ফিরছে। তবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, আইন প্রয়োগ ও বিকল্প জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া এই পরিবর্তন স্থায়ী হবে না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















