সাধারণ বিবরণ:
রাজসাহী একটি বিস্তৃত জেলা। এই জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশের আকৃতি, প্রকৃতি, শস্য, জলবায়ু প্রভৃতি ভিন্ন প্রকার। সাধারণত ভূমি উর্বরা। শস্যক্ষেত্র নিম্ন। নদীর তীরে গ্রামসমূহ বৃক্ষ শ্রেণিতে শোভিত। উত্তর ও পশ্চিম ভাগে মালদহ, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার সংলগ্নস্থান বরেন্দ্র ভূমি। এই বরেন্দ্র ভূমি সমতল নহে উচ্চ ও নীচ। এবং ইহার মৃত্তিকা অনেক স্থানে রক্তবর্ণ। বৃক্ষ অতি কম, কেবল স্থানে স্থানে তালবৃক্ষ দেখা যায়। পশ্চিম হইতে পূর্বদিক পর্যন্ত বিল। পশ্চিমে মাঁদার বিল, পূর্বে চলনবিল এবং উত্তরে রক্তদহের বিল। মাঁদার বিল ও রক্তদহের বিল হইতে বরেন্দ্র ভূমি আরম্ভ। বর্ষাকালে অর্থাৎ জুলাই মাস হইতে নভেম্বর মাস পর্যন্ত জেলাটির প্রায় সকল স্থান জলে পরিপূর্ণ থাকে। বর্ষাকালে বিলের মধ্যে এক একটি গ্রাম এক একটি দ্বীপের ন্যায় জলে চারিদিকে পরিবেষ্টিত হয়। নদীর তীরে গ্রাম সমূহের জলবায়ু, সাধারণত স্বাস্থ্যকর। কিন্তু বিলের নিকটবর্তী গ্রামসমূহের জলবায়ু অস্বাস্থ্যকর। পদ্মা নদী স্ফীত হইয়া জলপ্লাবনে গ্রাম সমূহ প্রপীড়িত হয়। ১৮৩৮ ও ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের জল প্লাবন বিখ্যাত।
নদী:
বড় ছোট নদী ও জলাশয় দ্বারা জেলা আবৃত। এই সকল দ্বারা যেন একখানি জাল বুনিয়া সমস্ত জেলাকে আবৃত করিয়াছে। জেলার প্রায় সকল স্থানেই সকল সময় নৌকাপথে যাতায়াত করা যায়। প্রধান প্রধান নদীগুলি উল্লেখ করা গেল।
(১) পদ্মা নদী-ভাগীরথী হইতে বহির্গত। জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম ভাগে অবস্থিত। সকল সময় বিশেষত বর্ষাকালে এ নদী ভয়ঙ্কর দেখায়। বর্ষাকালে এই নদীর তরঙ্গ দেখিলে প্রাণ উড়িয়া যায়। যে স্থানে বৃহৎ চর হইয়া শস্য হইতে লাগিল কিছুদিন পরে আবার সেই স্থানে, সে চর নাই, সে বৃক্ষ নাই, সে শস্য নাই, কেবল অতলস্পর্শ জলরাশি। এই নদীর রেতী মৃত্তিকা এত উর্বর যে, চরে প্রচুর পরিমাণে ধান্য, কলাই, পটল, তরমুজ প্রভৃতি জন্মে। ইহার তীরে প্রধান নগর গোদাগাড়ি, রামপুর-বোয়ালিয়া, সরদহ, রাজাপুর, লালপুর, দামুকদিয়া ও সাঁড়া।
(২) মহানন্দা-হিমালয় পর্বত হইতে বহির্গত। জেলার পশ্চিম দিক দিয়া প্রবাহিত। বাসুদেবপুর দিয়া গোদাগাড়ির নিকট পদ্মা নদীতে পতিত হইয়াছে। পূর্ণিয়া ও মালদহ জেলার মধ্য দিয়া প্রবাহিত। এ নদী বিস্তৃত ও গভীর। বোঝাই নৌকা অনায়াসে যাতায়াত করিতে পারে।
(৩) আত্রাই-তিস্তা বা তিস্রোতা নদী হইতে বহির্গত। এ নদী অতি পবিত্র ও প্রসিদ্ধ। দিনাজপুর হইয়া রাজসাহী জেলায় প্রবিষ্ট। দিঘাপতিয়ার অনতিদূরে বাকসর গ্রামের নিকট বন্ধ। নতুন জোলা অথবা পুঠিয়ার জোলা নাম গ্রহণে লালোরের পূর্ব দিক দিয়া পুনরায় আত্রাইতে মিশিয়া বিল চলনে পতিত হইয়াছে। আবার সেই জোলা সেরকোলের নিকট আত্রাই হইতে পৃথক হইয়া কলম দিয়া বিল চলনে মিশ্রিত হইয়াছে। আত্রাইর তীরে প্রধান নগর-মহাদেবপুর, কালিকাপুর (মাঁদা পুলিশ স্টেশন), প্রসাদপুর, বান্দাইখাড়া, আত্রাই রেলওয়ে স্টেশন, সাহেবগঞ্জ (মোহিনীমোহন রায়ের জমিদারি কাছারি), খাজুরা, ডাঙাপাড়া, আত্রাইকুলা, স্টেশন অতি নিকট। লালোর। এই নদীর উপর উত্তর-বঙ্গ রেলওয়ের একটি লৌহসেতু আছে। সেতু হইতে আত্রাই
(৪) বড়ল-সরদহের নিকট পদ্মা হইতে বহির্গত হইয়া হুড়া সাগরে পতিত। কেবল বর্ষার সময় নৌকায় যাতায়াত করিতে পারা যায়। অন্য সময় সরদহর নিকট মুখ বন্ধ থাকে। ইহার তীরে বা নিকটে প্রধান গ্রাম-চারঘাট, আড়ানী, পাঁকা, গালিমপুর, মালঞ্চি (রেলওয়ে স্টেশন), ধুপৈল (এই গ্রামের নিকট নন্দাকুজা নদীর মুখ), ওয়ালিয়া, জোয়ান্ডী, হরিপুর, চাটমোহর, নুননগর (এই স্থানে বিল চলনের সহিত মিশ্রিত)। এই নদীর উপর উত্তরবঙ্গ রেলওয়ের লৌহ সেতু আছে। সেতু হইতে মালঞ্চি স্টেশন অতি নিকট।
(৫) মুযাখাঁ-বড়ল নদীর একটি শাখা। আড়ানীর অনতিদূরে বড়ল নদী হইতে বহির্গত। আত্রাই নদীতে বাকসরের নিকট মিশ্রিত। কেবল বর্ষার সময় নৌকা যাতায়াত করে। ইহার তীরে বা নিকটে প্রধান গ্রাম পুঠিয়া রাজধানী, ঝলমলিয়া হাট, মধুখালী, ভাবনী, ছাতনী, বেলঘরিয়া, দিঘাপতিয়া রাজধানী।
(৬) নারদ-এক্ষণ মুষাখা নদীর শাখা। পূর্বে পদ্মা নদী হইতে রামপুর বোয়ালিয়ার নিকট দিয়া বহির্গত হইয়া প্রসিদ্ধ নাটোর নগর দিয়া প্রবাহিত। পুঠিয়ার নিকট নারদের মুখ বন্ধ। নারদ নদী ধরাইল গ্রাম দিয়া গুনাইখাড়ার নিকট আত্রাই নদীর সহিত মিশ্রিত। গুনাইখাড়ার মুখ হইতে নাটোর নগর পর্যন্ত বর্ষাকালে নৌকা যাতায়াত করিতে পারে।
(৭) নাগর-করতোয়া নদীর একটি শাখা, বগুড়া জেলা হইতে রাজসাহী প্রবিষ্ট। তেমুখ-নওগাঁও গ্রামের নিকট যমুনা বা গুড় নদীতে পতিত। নাগর নদীর গতি নিতান্ত বক্র। সকল সময় নৌকা যাতায়াত করিতে পারে। নদীর তীরে প্রধান গ্রাম-পতিসর, কুসুম্বী, চাঁপাপুর, দুপচাঁচিয়া। সুলতানপুর-বগুড়া রেলপথ এই নদী পার হইয়া গিয়াছে।
(৮) যমুনা-দিনাজপুর হইতে আসিয়া প্রথমে বালুভরা, নওগাঁও, কাসিমপুর ও ভবানীপুর গ্রামের নিচ দিয়া প্রবাহিত হয়। ভবানীপুরের নিকট আত্রাই ও যমুনা একত্রিত হইয়া আত্রাই রেলওয়ে স্টেশনের নিকট যমুনা পূর্বদিকে এবং আত্রাই দক্ষিণ পূর্বদিকে প্রবাহিত হইতেছে। আত্রাই স্টেশন হইতে যমুনা নদী গুড় নদী বলিয়া প্রসিদ্ধ এবং গুমানীর নিকট বিল চলনে পতিত হইয়া পাবনা জেলায় প্রবিষ্ট। এই নদীর তীরে প্রসিদ্ধ গ্রাম গুড়নই ও কলম।
(৯) বারানই-মাঁদার বিল হইতে বহির্গত হইয়া পিপরুল গ্রামের মধ্যে কালীগঞ্জ নামক হাটের নিকট আত্রাই নদীতে পতিত। আবার মাঁদা বিল হইতে বন্দিপুরের দাঁড়া দ্বারা বেজোড়া গ্রামের নিকট আত্রাই নদীর সহিত মিশ্রিত। রামপুরবোয়ালিয়া হইতে নওহাটা ১০ মাইল দূর। এই নওহাটা বারানই নদী তীরে। এই স্থান হইতে নদী বেশি গভীর। ইহা অপ্রশস্ত কিন্তু অত্যন্ত গভীর। এই নদীর তীরে প্রসিদ্ধ তাহিরপুর রাজার বাসস্থান। বাগমারা পুলিশ স্টেশনও এই নদীর তীরে। এই নদীর উপর উত্তরবঙ্গ রেলওয়ের নলডাঙার লৌহ সেতু নির্মিত আছে। এই সেতু হইতে মাধনগর স্টেশন অতি নিকট।
বিল:
জেলায় ছোট বড় অনেক বিল আছে, তন্মধ্যে বিল চলন বৃহৎ এবং সকল সময় নৌকায় যাতায়াত করা যায়। বিল চলনের আয়তন প্রায় ১৫০ বর্গ মাইল। নাটোর হইতে বগুড়া পর্যন্ত যে রাস্তা আছে, সেই রাজপথের উপর সিংড়া থানা। সেই সিংড়া হইতে বড়ল নদীর তীরে পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর পর্যন্ত বিল চলন ২১ মাইল বিস্তৃত। বর্ষা ব্যতীত অন্য সময় বিলের আয়তন হ্রাস হয়। মাঁদা, রক্তদহ এবং সতীর বিলও নিতান্ত ছোট নহে।
রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৩)
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০৪:১৭:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
- 70
জনপ্রিয় সংবাদ




















