০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না’ বীরকে —তাইওয়ানে গোপন মিশনে শহীদ উউ শিকে স্মরণ করছে চীন বার্নার্ড জুলিয়ানের করুণ জীবন— যার উত্থান ও পতন সমান নাটকীয় ১৯২৯—যে বছরে ভেঙে পড়েছিল আমেরিকার স্বপ্ন নগদহীন পেমেন্ট ভালো—কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলে সমস্যা মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৫৭) হংকং বাজারে সানি হেভি ইন্ডাস্ট্রির শেয়ার বিক্রি শুরু বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড বাণিজ্য সহযোগিতা জোরদারে বিএফটিআই ও আইটিডি’র মধ্যে সমঝোতা স্মারক রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ: গণভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা- আসিফ নজরুল সৎপুত্রের হাতে আহত নারী ঢাকায় মারা গেলেন ঝিনাইদহে নবগঙ্গা নদীতে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

মিয়ানমারে সাজানো নির্বাচন ও বর্ধমান নৃশংসতার প্রমাণ

সেনাশাসনের নতুন মুখোশ

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর আরোপিত চার বছরের জরুরি অবস্থা তারা তুলে নিয়েছে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন গঠন করেছে। এই সরকার ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত ধাপে ধাপে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কেবল বাহ্যিক সাজসজ্জা। সামরিক বাহিনী এখনো দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় রয়েছে এবং গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে তাদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে চাইছে।

জাতিসংঘের ভয়াবহ অভিযোগ

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, মিয়ানমারে নৃশংসতা আরও বেড়েছে। প্রমাণ পাওয়া গেছে—

  • • আটক ব্যক্তিদের ওপর নিয়মিত নির্যাতন ও পদ্ধতিগত টর্চার,
  • • গ্রেফতারকৃত যোদ্ধা ও তথাকথিত “গোপন খবরদাতা” বেসামরিকদের গুলি করে হত্যা,
  • • দুই বছরের শিশুদেরও বাবা-মায়ের বদলে আটক করা,
  • • স্কুল, হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে বিমান হামলা।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, যার ফলে অনেক বন্দির মৃত্যু ঘটেছে।

চার বছরের গৃহযুদ্ধ

২০২১ সালে অং সান সু চির সরকার উৎখাত করে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা দখল করেন। এরপর থেকে দেশজুড়ে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনারা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে এবং তরুণদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তির চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে।

সাজানো নির্বাচন

জান্তা দাবি করছে, তারা “গণতন্ত্র ও ফেডারেল ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি সৎ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ বহুদলীয় নির্বাচন” আয়োজন করছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা এটিকে সম্পূর্ণ ভুয়া নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। বিরোধী নেতা ও কর্মীরা হয় জেলে নয় নির্বাসনে আছেন, গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এবং জনগণের জন্য ভোট দেওয়া নিরাপদ নয়।

নারী অধিকারকর্মী মি কুন চান নন সিএনএনকে বলেছেন, “এটি একটি ভুয়া নির্বাচন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, বৈধও নয়।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো কখনোই জান্তাকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাপান ও মালয়েশিয়াও এ নির্বাচনের সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৎ নির্বাচন সম্ভব নয়।

চীন ও রাশিয়া জান্তার প্রধান সমর্থক, আর প্রতিবেশী ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্ত সংকট মোকাবেলায় জান্তার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

সহিংসতার শঙ্কা

দেশের বহু অঞ্চল এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাখাইন অঙ্গরাজ্যের শক্তিশালী আরাকান আর্মি জানিয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভোট হতে দেবে না। নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।

৬০টির বেশি টাউনশিপে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভোটের সময় আরও সহিংসতা বাড়বে।

দমননীতি আরও কঠোর

ভোটের আগে নতুন আইন আনা হয়েছে, যেখানে নির্বাচনের সমালোচনা করলেই দীর্ঘ কারাদণ্ডের শাস্তি হতে পারে। নতুন সাইবার আইনও পাস হয়েছে, যাতে ভিপিএন ব্যবহার ও নিষিদ্ধ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

পুরনো কৌশল, নতুন রূপ

মিন অং হ্লাইং একটি নতুন কমিশন—জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি কমিশন (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড পিস কমিশন)—গঠন করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি পুরনো কৌশল—“পুরনো মদ নতুন বোতলে।” জান্তা এখনো অটলভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

১৯৬২ সাল থেকে বারবার সামরিক শাসন মিয়ানমারকে ধ্বংস করেছে। ২০০৮ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী আংশিক বেসামরিক সরকার গঠনের পথ খুলে দেয়। পরবর্তী দশকে কিছু বিনিয়োগ ও গণতান্ত্রিক সংস্কার এসেছিল, কিন্তু সামরিক বাহিনী কখনোই পূর্ণ ক্ষমতা ছাড়েনি।

২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির দল আবারও বিজয়ী হলে সেনারা অভ্যুত্থান ঘটায়। বর্তমানে ৮০ বছর বয়সী সু চি কারাগারে বন্দি, তার সঠিক অবস্থানও গোপন রাখা হয়েছে।

জান্তার নতুন প্রচারণা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ের জন্য তারা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩০ লাখ ডলারের চুক্তি করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপকে জান্তা দেশীয় প্রচারণায় ব্যবহার করছে।

তবে মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করেছেন—এই নির্বাচনী নাটক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন কোনোভাবেই গ্রহণ না করে।

সাধারণ মানুষের বাস্তবতা

একজন নারী অধিকারকর্মী বলেন, “শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, ব্যবসা কেবল জান্তার ঘনিষ্ঠদের জন্য। সবকিছু ভেঙে পড়েছে। তাই নির্বাচন-পরবর্তী কোনো শান্তি প্রক্রিয়ায় জনগণের অবস্থা উন্নত হবে না।”

জনপ্রিয় সংবাদ

মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না’ বীরকে —তাইওয়ানে গোপন মিশনে শহীদ উউ শিকে স্মরণ করছে চীন

মিয়ানমারে সাজানো নির্বাচন ও বর্ধমান নৃশংসতার প্রমাণ

০৫:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

সেনাশাসনের নতুন মুখোশ

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর আরোপিত চার বছরের জরুরি অবস্থা তারা তুলে নিয়েছে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন গঠন করেছে। এই সরকার ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত ধাপে ধাপে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কেবল বাহ্যিক সাজসজ্জা। সামরিক বাহিনী এখনো দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় রয়েছে এবং গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে তাদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে চাইছে।

জাতিসংঘের ভয়াবহ অভিযোগ

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, মিয়ানমারে নৃশংসতা আরও বেড়েছে। প্রমাণ পাওয়া গেছে—

  • • আটক ব্যক্তিদের ওপর নিয়মিত নির্যাতন ও পদ্ধতিগত টর্চার,
  • • গ্রেফতারকৃত যোদ্ধা ও তথাকথিত “গোপন খবরদাতা” বেসামরিকদের গুলি করে হত্যা,
  • • দুই বছরের শিশুদেরও বাবা-মায়ের বদলে আটক করা,
  • • স্কুল, হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে বিমান হামলা।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, যার ফলে অনেক বন্দির মৃত্যু ঘটেছে।

চার বছরের গৃহযুদ্ধ

২০২১ সালে অং সান সু চির সরকার উৎখাত করে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা দখল করেন। এরপর থেকে দেশজুড়ে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনারা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে এবং তরুণদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তির চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে।

সাজানো নির্বাচন

জান্তা দাবি করছে, তারা “গণতন্ত্র ও ফেডারেল ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি সৎ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ বহুদলীয় নির্বাচন” আয়োজন করছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা এটিকে সম্পূর্ণ ভুয়া নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। বিরোধী নেতা ও কর্মীরা হয় জেলে নয় নির্বাসনে আছেন, গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এবং জনগণের জন্য ভোট দেওয়া নিরাপদ নয়।

নারী অধিকারকর্মী মি কুন চান নন সিএনএনকে বলেছেন, “এটি একটি ভুয়া নির্বাচন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, বৈধও নয়।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো কখনোই জান্তাকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাপান ও মালয়েশিয়াও এ নির্বাচনের সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৎ নির্বাচন সম্ভব নয়।

চীন ও রাশিয়া জান্তার প্রধান সমর্থক, আর প্রতিবেশী ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্ত সংকট মোকাবেলায় জান্তার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

সহিংসতার শঙ্কা

দেশের বহু অঞ্চল এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাখাইন অঙ্গরাজ্যের শক্তিশালী আরাকান আর্মি জানিয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভোট হতে দেবে না। নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।

৬০টির বেশি টাউনশিপে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভোটের সময় আরও সহিংসতা বাড়বে।

দমননীতি আরও কঠোর

ভোটের আগে নতুন আইন আনা হয়েছে, যেখানে নির্বাচনের সমালোচনা করলেই দীর্ঘ কারাদণ্ডের শাস্তি হতে পারে। নতুন সাইবার আইনও পাস হয়েছে, যাতে ভিপিএন ব্যবহার ও নিষিদ্ধ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

পুরনো কৌশল, নতুন রূপ

মিন অং হ্লাইং একটি নতুন কমিশন—জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি কমিশন (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড পিস কমিশন)—গঠন করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি পুরনো কৌশল—“পুরনো মদ নতুন বোতলে।” জান্তা এখনো অটলভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

১৯৬২ সাল থেকে বারবার সামরিক শাসন মিয়ানমারকে ধ্বংস করেছে। ২০০৮ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী আংশিক বেসামরিক সরকার গঠনের পথ খুলে দেয়। পরবর্তী দশকে কিছু বিনিয়োগ ও গণতান্ত্রিক সংস্কার এসেছিল, কিন্তু সামরিক বাহিনী কখনোই পূর্ণ ক্ষমতা ছাড়েনি।

২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির দল আবারও বিজয়ী হলে সেনারা অভ্যুত্থান ঘটায়। বর্তমানে ৮০ বছর বয়সী সু চি কারাগারে বন্দি, তার সঠিক অবস্থানও গোপন রাখা হয়েছে।

জান্তার নতুন প্রচারণা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ের জন্য তারা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩০ লাখ ডলারের চুক্তি করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপকে জান্তা দেশীয় প্রচারণায় ব্যবহার করছে।

তবে মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করেছেন—এই নির্বাচনী নাটক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন কোনোভাবেই গ্রহণ না করে।

সাধারণ মানুষের বাস্তবতা

একজন নারী অধিকারকর্মী বলেন, “শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, ব্যবসা কেবল জান্তার ঘনিষ্ঠদের জন্য। সবকিছু ভেঙে পড়েছে। তাই নির্বাচন-পরবর্তী কোনো শান্তি প্রক্রিয়ায় জনগণের অবস্থা উন্নত হবে না।”