সন্ধ্যা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি মূলত এরিয়েল খান নদীর একটি শাখা হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে এবং পরবর্তীতে কাঁচা নদীতে গিয়ে মিশে। গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও পিরোজপুর জেলার সীমানা বরাবর নদীর প্রবাহ বিস্তৃত। সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থান করার কারণে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের জলপ্রবাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই নদীর ভৌগোলিক অবস্থান স্থানীয় অর্থনীতি, কৃষি এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
সুন্দরবনের সঙ্গে সম্পর্ক
সন্ধ্যা নদী সুন্দরবনের জটিল নদীনির্ভর পরিবেশব্যবস্থার একটি অংশ। সুন্দরবনের জলাভূমি ও খালগুলোতে পানি প্রবাহের জন্য সন্ধ্যা নদীর মতো নদীগুলো অপরিহার্য। এ নদীর স্রোত সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমকে জীবন্ত রাখে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, ইরাবতী ডলফিন, হরিণ ও অসংখ্য পাখি এবং মাছ এই অঞ্চলের নদী ও বনের ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায়, সন্ধ্যা নদী সুন্দরবনের প্রাণকেন্দ্রকে বহন করে নিয়ে চলেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও নৌযাত্রা
অতীতে সন্ধ্যা নদী নৌযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গ্রামীণ মানুষ ছোট নৌকা বা পালতোলা নৌযান ব্যবহার করে এই নদীপথে চলাফেরা করত এবং পণ্য পরিবহন করত। পিরোজপুরের নেসারাবাদ (বর্তমানে স্বরূপকাঠি) উপজেলা সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এটি দীর্ঘদিন ধরে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানকার জাহাজ নির্মাণশিল্প নদীর জলসম্পদ ও প্রাকৃতিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে সন্ধ্যা নদী ঐতিহাসিকভাবে বাণিজ্য, পরিবহন ও গ্রামীণ জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব
নদীটি তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস। সন্ধ্যা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বৃহৎ কাঠের বাজার। সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা কাঠ এই নদীপথে এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া নদীতে প্রচুর মাছ ধরা হয়, যা স্থানীয় মানুষদের প্রধান আয়ের উৎস। হাজার হাজার জেলে প্রতিদিন নদীতে মাছ ধরতে নামে এবং তাদের জীবিকা এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজেও নদীর পানি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন
সন্ধ্যা নদী তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত। নদীর দুই তীরজুড়ে সবুজ গাছপালা এবং বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীর পানি এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে। ভ্রমণপ্রেমীরা নৌকায় ভ্রমণ করে এই নদীর দৃশ্য উপভোগ করে থাকে। সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে সন্ধ্যা নদীর সৌন্দর্য একটি বাড়তি আকর্ষণ। বিশেষ করে ভোরের সূর্যোদয় ও সন্ধ্যার সূর্যাস্ত এই নদীর বুকে অসাধারণ দৃশ্য উপহার দেয়।
সন্ধ্যা নদীর জলসম্পদ
সন্ধ্যা নদীকে এক কথায় জলসম্পদের ভাণ্ডার বলা যায়।
মৎস্য সম্পদ: ইলিশ, রুই, কাতলা, বোয়াল, শিং, মাগুরসহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ এই নদীতে পাওয়া যায়।
কৃষিতে ভূমিকা: নদীর পানি কৃষিজমি উর্বর রাখে এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়।

জলজ প্রাণী: নদী কুমির, কাঁকড়া, শামুক, জলচর পাখি ও বিভিন্ন জলজ প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।
মানুষের জীবন: মাছ ধরা, কাঠ পরিবহন, কৃষিকাজ ও নৌকা চালানো—এসব কাজে নদী মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
নদীটি শুধু অর্থনীতিই নয়, পরিবেশকেও সমৃদ্ধ করেছে। সন্ধ্যা নদীর পানি সুন্দরবনের জলাভূমিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। নদীর তীরে পাখিদের বসবাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই নদী অপরিহার্য।
সংকট ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে সন্ধ্যা নদী নানা সংকটের মুখোমুখি। শিল্পবর্জ্য ও প্লাস্টিকের কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। অবৈধ দখল ও অতিরিক্ত বালু উত্তোলন নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নদীর স্বাভাবিক গতি ও গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে অতিরিক্ত মাছ ধরা ও কাঠ আহরণের কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

ভবিষ্যৎ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
সন্ধ্যা নদীকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নদীর তীর অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে এবং বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মাছ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে নদীর সম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার করতে হবে। একইসঙ্গে সুন্দরবন সংরক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সন্ধ্যা নদীকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
ইতিহাসে এটি ছিল নৌযাত্রা ও জাহাজ নির্মাণের কেন্দ্র
সন্ধ্যা নদী শুধু একটি নদী নয়—এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত জীবনের প্রতীক। ইতিহাসে এটি ছিল নৌযাত্রা ও জাহাজ নির্মাণের কেন্দ্র, বর্তমানে এটি কাঠ ব্যবসা, মাছ আহরণ, কৃষি ও পর্যটনের প্রধান ভরসা। জলসম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে এই নদীকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে এটি আগামী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















