সোহেল চৌধুরী ১৯৬৩ সালে হবিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে তিনি মধ্যবিত্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত ও শিল্পপ্রবণ। বন্ধুদের আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা নাটক—সব জায়গাতেই তাঁর উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত। পরিবারের পক্ষ থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহ পেতেন।
যদিও ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করা সহজ ছিল না, তবুও তাঁর স্বপ্ন ছিল বড় পর্দায় নায়ক হওয়ার। পড়াশোনার পর তিনি অভিনয়কে বেছে নেন জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে।
নতুন মুখের সন্ধানে জয়
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) আয়োজিত প্রতিযোগিতা “নতুন মুখের সন্ধানে” ১৯৮৪ সালে সোহেল চৌধুরীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে তিনি সরাসরি চলচ্চিত্রে সুযোগ পান। একই আসরে বিজয়ী হয়েছিলেন পারভীন সুলতানা দিতি। তাঁদের দুজনের জয় শুধু ক্যারিয়ারের দিক থেকেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়।
চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার
৮০-র দশকে সোহেল চৌধুরী একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর প্রথমদিকের ছবিগুলো ছিল সামাজিক ও রোমান্টিক ধারার। উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—
- •পর্বত(১৯৮৬)
- • লক্ষ্মী বধূ(১৯৮৭)
- • হীরামণি(১৯৮৮)
- • বিরহ ব্যথা(১৯৮৯)
তাঁর অভিনয় দক্ষতা দর্শকের কাছে প্রশংসিত হলেও নায়িকা দিতি বা সমসাময়িক অন্য তারকাদের মতো তাঁর ক্যারিয়ার দ্রুত বিস্তৃত হয়নি। তবুও তিনি সম্ভাবনাময় একজন অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৮৬ সালে সহঅভিনেত্রী দিতিকে বিয়ে করেন সোহেল। তাঁদের সংসার ছিল বিনোদন জগতের আলোচিত একটি অধ্যায়। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় তাঁদের কন্যা লামিয়া, ১৯৮৯ সালে জন্ম নেয় পুত্র দিপ্তা। শুরুতে সংসার সুখী হলেও পরবর্তীতে নানা কারণে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে।
বিচ্ছেদের পর সন্তানদের দায়িত্ব তাঁরা আলাদাভাবে সামলালেও সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা দুজনের কাছেই সমান ছিল। এই ভাঙন সোহেলের ব্যক্তিগত জীবনকে অস্থির করে তোলে।
হত্যাকাণ্ড: এক অকাল মৃত্যু
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে ঢাকার বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন সোহেল চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনি ক্লাব থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
ক্লাবটিকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে অসামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরোধ চলছিল। তদন্তে উঠে আসে যে এসব দ্বন্দ্বই মূলত হত্যাকাণ্ডের কারণ। সোহেলের মৃত্যু পুরো চলচ্চিত্রাঙ্গন ও সাধারণ মানুষকে স্তম্ভিত করে তোলে।
দীর্ঘসূত্রিতার বিচার
হত্যার পরপরই মামলা দায়ের হলেও প্রভাবশালী আসামিদের কারণে বিচারপ্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। বছরের পর বছর কেটে যায়, কিন্তু রায় ঘোষণা হয় না। পরিবার ন্যায়বিচারের আশায় পথ চেয়ে থাকে।
অবশেষে প্রায় ২৬ বছর পর, ২০২৪ সালের মে মাসে আদালত তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তাঁদের মধ্যে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইও ছিলেন। এই রায় দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেও, পরিবারের কাছে তা যথেষ্ট মনে হয়নি।
পরিবারের প্রতিক্রিয়া
সোহেলের মেয়ে লামিয়া বলেন, “রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের একটি ধাপ পাওয়া গেলেও বাবাকে হারানোর বেদনা কোনোদিন পূরণ হবে না।” ছেলে শফায়েত বিদেশে পড়াশোনা শেষে ইউরোপে স্থায়ী হয়েছেন।
অভিনেত্রী দিতি বিচ্ছেদের পরও সন্তানদের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্যে স্বামীর হত্যার বিচার দাবি করে গেছেন।
উত্তরাধিকার
সোহেল চৌধুরীকে আজও স্মরণ করা হয় একজন প্রতিশ্রুতিশীল নায়ক হিসেবে, যিনি হয়তো বেঁচে থাকলে ঢালিউডে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। তাঁর জীবন ও মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গন কেবল সাফল্য নয়, অকাল মৃত্যুর করুণ গল্পও বহন করে।
তাঁর নাম জড়িয়ে আছে এক অসমাপ্ত ক্যারিয়ার, এক করুণ হত্যা ও দীর্ঘ বিচার বিলম্বের অধ্যায়ের সঙ্গে। তবুও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা তাঁকে স্মরণ করেন এক তরুণ তারকা হিসেবে, যিনি সবকিছু হারিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক অমলিন স্মৃতি।