কূটনীতির কুয়াশা
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চলমান কূটনীতি যেন এক ধরনের অভিনয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শান্তি চাইছেন বলে ভান করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁকে বিশ্বাস করছেন বা অন্তত তাই মনে করছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারাও ভান করছেন তাঁরা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেন। আলাস্কা ও ওয়াশিংটনে হওয়া শীর্ষ সম্মেলনগুলোও এই ভানভর্তি কূটনীতির প্রতিফলন—বেশি শব্দ, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
তবে একে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যাবে না। প্রতিটি নেতা কিছু না কিছু অর্জন করেছেন। আলাস্কায় গিয়ে পুতিন ট্রাম্পকে শান্ত করেন, নিজের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করেন—মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসে ইউরোপ ভাগাভাগি করা। ট্রাম্প ঘরোয়া চাপ থেকে মুক্তি পান—রাশিয়ার ওপর কঠোর তেল নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য পদক্ষেপ না নিলেও চলবে। ওয়াশিংটনে ইউক্রেন ও ইউরোপ পেল যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি এবং আলোচনার টেবিলে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করল। ট্রাম্পও সমালোচকদের আশ্বস্ত করলেন, তিনি ন্যাটো মিত্রদের পেছনে ফেলে পুতিনের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করছেন না।
ট্রাম্পের পরিবর্তনশীল কৌশল
প্রথমদিকে ট্রাম্প ইউক্রেন ও ইউরোপকে চাপ দিতেন আর রাশিয়াকে সুবিধা দিতেন। এখন তাঁর কৌশল খানিকটা বদলেছে। তবু তিনি অস্থিরচরিত্রের নেতা—একদিকে স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন, আবার অন্যদিকে দাবি করেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের যা খুশি করার অধিকার আছে। ফলে তিনি যেকোনো সময় আবার ইউক্রেন ও ইউরোপকে হুমকি দিতে পারেন।
কিন্তু ইউক্রেনের জনগণ যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা কাউকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে দেবে না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বিপক্ষে ইউক্রেন নয়, তবে তা হতে হবে সম্মানের সঙ্গে। ইউরোপ সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে না নিলে এবং অভ্যন্তরীণভাবে ভেঙে না পড়লে ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে না।
নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রশ্ন
মস্কোর ভঙ্গ প্রতিশ্রুতির ইতিহাস জানে কিয়েভ। তাই তারা টেকসই নয় এমন কোনো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। ট্রাম্প অন্তত এটুকু বোঝেন এবং ইউক্রেনকে “ন্যাটো-সদৃশ” নিরাপত্তা নিশ্চয়তার কথা বলেছেন।
কিন্তু ন্যাটো ও “ন্যাটো-সদৃশ” নিরাপত্তার পার্থক্য বিশাল। বাস্তবে কেউ ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ করবে না। তারা শুধু অস্ত্র, সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। বিশেষ করে ইইউ সদস্যপদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে শক্তিশালী করলেও ইইউতে, না নিলে পুতিনের আশা থেকেই যাবে যে একদিন সে ইউক্রেনকে আবার নিজের প্রভাববলয়ে টেনে নেবে।
মস্কো অবশ্য এসব নিশ্চয়তা আটকে দিতে চায়। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এমনকি দাবি তুলেছেন যে রাশিয়াকেও ইউক্রেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অংশ নিতে হবে। ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট স্মারকচুক্তির উল্লেখ করে তিনি এই যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। ইউক্রেনীয়রা এমন ফাঁদে আর কখনো পড়বে না।
যুদ্ধ থামানোর কৌশল
আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো যুদ্ধবিরতি বনাম স্থায়ী শান্তি। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ইউক্রেন ও ইউরোপ মেনে নেয়। কিন্তু পুতিন সরাসরি স্থায়ী শান্তিচুক্তির কথা তুললেন, যা ট্রাম্পও পরে গ্রহণ করলেন।
কিন্তু এ প্রস্তাব আসলে সময়ক্ষেপণের কৌশল। স্থায়ী শান্তি মানে দীর্ঘ আলোচনা, বেশি ছাড়, আর সেই ফাঁকে রুশ সেনারা আরও এলাকা দখল করবে, আরও মানুষ হত্যা করবে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকেও বিরত রাখা যাবে।
পুতিন আবার “সংঘাতের মূল কারণ” খোঁজার নামে আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে চান। তাঁর দাবি, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাই মূল সমস্যা। অথচ আসল কারণ ইউক্রেনের স্বাধীন অস্তিত্ব—যা তিনি বারবার অস্বীকার করেছেন।
ভূমি প্রশ্নে বিতর্ক
সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো ভূমি দখল। একটি অন্তর্বর্তী সমাধান হতে পারে—দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে ধূসর অবস্থায় রাখা, যেখানে দুই পক্ষই দাবি করবে এ তাদের এলাকা। তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে বহু বছর এভাবে শান্তি টিকে আছে। তবে এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্প পুতিনের “ভূমি বিনিময়” প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। এর মানে চোরকে গাড়ি ফেরত না দিয়ে শুধু সাইকেল ফেরত দিতে বলার মতো অবস্থা। ইউক্রেনের কাছে এটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, কারণ আইন অনুযায়ীও এটি বেআইনি এবং জনগণ এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। এতে সরকার পড়ে যাবে, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব “ভূমি বিনিময়” শব্দটি বাদ দিতে হবে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শীর্ষ সম্মেলন
ট্রাম্প পুতিন ও জেলেনস্কিকে নিয়ে এক যৌথ সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এমন একটি বৈঠক বড় ঘটনা হবে। যদিও এটি যুদ্ধের অবসান নিশ্চিত করবে না, তবু কিছু পদক্ষেপে অগ্রগতি সম্ভব।
জেলেনস্কি ২০২২ সাল থেকেই পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার পক্ষে। কিন্তু ক্রেমলিন নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে যাচ্ছে। যদি পুতিন আবার এ সম্মেলন এড়িয়ে যান, তবে বোঝা যাবে তিনি কেবল সময় নষ্ট করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছেন।
ইউক্রেনের সংগ্রাম অব্যাহত
রাশিয়ার উদ্দেশ্য এখনো অপরিবর্তিত। তারা এখনো হামলার শক্তি রাখে। ইউক্রেনও লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম এবং তারা স্বাধীনতা সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র রাখবে না।
ইউরোপ সামরিক সহায়তা বাড়াচ্ছে, তবে গতি বাড়াতে হবে। এখনো বিশ্ব ইউক্রেনকে যথেষ্ট সমর্থন দিচ্ছে না। কেবল কূটনৈতিক বিবৃতি, শীর্ষ সম্মেলন বা সামাজিক মাধ্যমের প্রচারণা দিয়ে কাজ হবে না। ইউক্রেনের আসল চাহিদা বোঝা এবং তা পূরণের কৌশল তৈরি করলেই শান্তির সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।
ভূমি নয়, মর্যাদা—ইউক্রেনের সংগ্রামের মূল কথা
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ১২:০৭:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- 53
জনপ্রিয় সংবাদ

























