পরিচিতি
সমুদ্রসৈকতে যারা ভ্রমণ করেন, তারা হঠাৎ বালুর ভেতর দৌড়ঝাঁপ করা এক অদ্ভুত কাঁকড়াকে প্রায়ই চোখে পড়তে দেখেন। এরা ক্ষুদ্রাকৃতি, হালকা বর্ণের, আর প্রায়ই অন্ধকার বা ভোরবেলায় সৈকতের বালু থেকে বেরিয়ে আসে। এদের নাম ভূত কাঁকড়া (Ghost Crab)। নামের সঙ্গেই রয়েছে রহস্য: তাদের দৌড়ঝাঁপ, সাদা রঙ, আর দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যেন ভূতের মতোই এক অদেখা উপস্থিতি সৃষ্টি করে।
আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
ভূত কাঁকড়া সাধারণত ছোট আকারের হয়—দেহের প্রস্থ ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে। রঙ হালকা ধূসর, সাদা কিংবা বালুময় বাদামি, ফলে তারা সৈকতের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। তাদের চোখ দুটি লম্বা ডাঁটির ওপর থাকে, যা অনেক দূর থেকে শিকার বা বিপদ দেখতে সাহায্য করে। একদিকে বড় ও শক্তিশালী পাঞ্জা থাকে, অন্য পাঞ্জা তুলনামূলকভাবে ছোট।
তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অবিশ্বাস্য দ্রুত দৌড়। প্রায় প্রতি সেকেন্ডে ১.৬ মিটার গতিতে ছুটতে পারে, যা তাদের ছোট্ট দেহের তুলনায় আশ্চর্যজনক দ্রুতগতি।
বাসস্থান ও গর্ত
ভূত কাঁকড়ারা মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্রসৈকতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও কক্সবাজার ও কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতে এদের সহজেই দেখা যায়। তারা সৈকতের শুষ্ক অংশে লম্বা গর্ত খুঁড়ে বাস করে। এই গর্তের গভীরতা কখনো কখনো এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
গর্তগুলো কেবল আশ্রয়স্থলই নয়, বরং তীব্র গরম থেকে বাঁচা ও শিকারির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়। প্রায়শই দেখা যায়, হঠাৎ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ভূত কাঁকড়া বিদ্যুৎগতিতে গর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়।
খাদ্যাভ্যাস
ভূত কাঁকড়া সর্বভুক। তারা মৃত মাছ, ছোট পোকা, শামুক কিংবা জোয়ার ভাটার সঙ্গে ভেসে আসা জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। কখনো তারা অন্য ছোট কাঁকড়াকে পর্যন্ত শিকার করে। সৈকতের পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা মৃত প্রাণী ও পচনশীল উপাদান খেয়ে সৈকতকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখে।
জীবনযাপন ও আচরণ
ভূত কাঁকড়া মূলত নিশাচর প্রাণী। দিনের আলোতে তারা খুব কমই বের হয়, সাধারণত ভোরবেলা বা সন্ধ্যায় সক্রিয় হয়। তবে পূর্ণিমার রাতে তাদের দৌড়ঝাঁপ বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
তাদের চলাফেরায় এক ধরনের ‘লাজুক’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা খুব সতর্ক, সামান্য শব্দ বা আলো টের পেয়েই দ্রুত পালিয়ে যায়। অনেক গবেষক তাদের সৈকতের প্রহরী হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কারণ তারা সৈকতের প্রতিটি নড়াচড়া সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।
প্রজনন
ভূত কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম সাধারণত গ্রীষ্মকালে। স্ত্রী কাঁকড়া শত শত ডিম দেয়, যা থেকে ছোট্ট প্ল্যাঙ্কটন সদৃশ লার্ভা বের হয়। এরা প্রথমে সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়, তারপর ধীরে ধীরে বড় হয়ে সৈকতে ফিরে আসে এবং বালুর ভেতর নিজেদের গর্ত তৈরি করে।
পরিবেশগত গুরুত্ব
যদিও তারা ছোট্ট প্রাণী, তবে ভূত কাঁকড়া সৈকতের ইকোসিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের উপস্থিতি সৈকতের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিকতা নির্দেশ করে। অনেক বিজ্ঞানী সৈকতের স্বাস্থ্য পরিমাপ করতে ভূত কাঁকড়ার সংখ্যা ও সক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করেন।
হুমকি ও সংরক্ষণ
পর্যটন বৃদ্ধি, সমুদ্রসৈকতে কৃত্রিম আলো, দূষণ এবং গর্ত ধ্বংসের ফলে ভূত কাঁকড়াদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে রাতের কোলাহল ও আলো তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত করে। অনেক স্থানে সৈকত উন্নয়নের নামে তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এ কারণে বিজ্ঞানীরা সৈকতে আলো দূষণ কমানো, মানুষের পদচারণা সীমিত করা, এবং প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ রাখার পরামর্শ দেন।
ভূত কাঁকড়া সমুদ্রসৈকতের এক রহস্যময় প্রাণী, যারা সৈকতের ভারসাম্য রক্ষায় নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের দৌড়ঝাঁপ ও আচরণে যেমন আনন্দ ও কৌতূহল রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রকৃতির প্রতি এক গভীর ইঙ্গিত—সৈকতের প্রতিটি প্রাণীই এই পরিবেশের অমূল্য অংশ।
তাদের সংরক্ষণ মানে কেবল একটি প্রাণীকে রক্ষা নয়, বরং পুরো সৈকত ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্য রক্ষা করা।