সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে, ঠান্ডা গুদামে রাখা আলুর ন্যূনতম মূল্য কেজি প্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করা হবে। এর নিচে আলু কেনা-বেচা হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে। সরকারের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো বাজারে আলুর দামের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রদান।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দাম কি কৃষকের উৎপাদন খরচ মিটিয়ে প্রকৃত লাভ দিতে পারবে, নাকি কেবল মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হবে?
উৎপাদন খরচের হিসাব
বিভিন্ন কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী:
- • কৃষকদেরপ্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় গড়ে ১৭ থেকে ২০ টাকা।
- • এই খরচের মধ্যে জমি প্রস্তুত,বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন অন্তর্ভুক্ত।
- • ফসল কাটার পর ঠান্ডা গুদামে সংরক্ষণ খরচ যোগ হয়,যা প্রতি কেজিতে আরও ৭ থেকে ৮ টাকা।
ফলে বাস্তবে কৃষকের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৫–২৮ টাকা প্রতি কেজি।

বাজারদর ও বাস্তবতা
- • গ্রামীণ বাজারে কৃষকরা আলু বিক্রি করছেন৭–১০ টাকা প্রতি কেজি দরে, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম।
- • শহরের কিছু পাইকারি বাজারে দাম তুলনামূলক বেশি হলেও (১১–১৫ টাকা),সেটাও উৎপাদন খরচ পূরণ করতে পারছে না।
- • ঘোষিত ২২ টাকা দাম বাজারে কার্যকর হলেও কৃষকরা বাস্তবে ঠান্ডা গুদামে জায়গা পেতে বা দামের সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। অনেকেই মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ব্যবসায়ীদের হাতে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন।
ঠান্ডা গুদামের খরচ ও অতিরিক্ত চাপ
- • গত বছর ঠান্ডা গুদামে আলু রাখার ভাড়া ছিল৭ টাকা প্রতি কেজি, এবার বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা।
- • কৃষক নিজেরাই যদি আলু সংরক্ষণ করতে চান,তবে উৎপাদন খরচের সাথে এই ভাড়া যোগ করে বাজারে বিক্রি করতে হয়। এতে তাদের জন্য ঘোষিত ২২ টাকা ন্যূনতম দামও যথেষ্ট নয়।
গত বছরের দামের তুলনা
- • গত বছর এক পর্যায়ে আলুর দাম বেড়ে হয়েছিল৮০ টাকা প্রতি কেজি, যা ছিল ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
- • অতিরিক্ত দাম দেখে এবার কৃষকেরা ব্যাপক হারে আলু আবাদ করেছেন,ফলে ১ কোটি ২৯ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে।
- • এই বিপুল উৎপাদনের কারণে দাম দ্রুত পড়ে গেছে,এবং এবার কৃষকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
- • ড. জহাঙ্গীর আলম খান,কৃষি অর্থনীতিবিদ:
“সরকার শুধু দাম ঘোষণা করে দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে, নইলে ঘোষিত দাম কার্যকর হবে না।” - • বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি:
তারা সতর্ক করেছেন,উৎপাদন খরচের নিচে দাম পেলে কৃষকেরা ভবিষ্যতে আলু আবাদে অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঠান্ডা গুদাম মালিকদের প্রস্তাব
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (BCSA) সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে:
প্রতি কেজিতে ৯ টাকা ভর্তুকি দেওয়ার দাবি।
সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে আলু অন্তর্ভুক্ত করা।
প্রতিবছর ১০ লাখ টন আলু সরকারি ক্রয় কর্মসূচির মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিতরণ করা, যাতে বাজার স্থিতিশীল থাকে।

কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গি
কৃষকেরা মনে করেন—
- • ঘোষিত দাম প্রশংসনীয় হলেও সংরক্ষণ খরচ,ভাড়া ও বাজার নিয়ন্ত্রণ না হলে এর সুফল তারা পাবেন না।
- • যদি সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে নেয়,তবে তারা প্রকৃত অর্থে লাভবান হবেন।
- • মধ্যস্বত্বভোগী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা নয়,বরং কৃষকই যেন দামের প্রধান সুবিধাভোগী হন, সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
উপসংহার
২২ টাকা ন্যূনতম দাম কাগজে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও বাস্তবে এটি কৃষকের লাভ নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়।
কেন যথেষ্ট নয়
- • উৎপাদন খরচ (১৭–২০ টাকা) + সংরক্ষণ খরচ (৭–৮ টাকা) = মোট ২৫–২৮ টাকা।
- • অথচ বাজারদর ৮–১৫ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

কী করা দরকার
সরকারি ক্রয় অভিযান বাড়ানো।
ঠান্ডা গুদামে ভাড়া কমানো বা ভর্তুকি দেওয়া।
আলুকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
বাজার তদারকি ও আইন প্রয়োগ শক্তিশালী করা।
আলুর ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ কৃষকবান্ধব একটি পদক্ষেপ হলেও খরচের তুলনায় এটি অপর্যাপ্ত। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের লাভ নিশ্চিত করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি ক্রয়, ভর্তুকি, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া শুধু ঘোষিত দাম কৃষকের দুঃখ ঘোচাতে পারবে না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















