০৫:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ইয়ামাহা মোটর, কুবোটা ও অন্যান্য জাপানি কোম্পানির আফ্রিকা পরিকল্পনা

আফ্রিকায় জাপান-চীন প্রতিযোগিতা

জাপান ও চীন সরকার যেমন আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, তেমনি তাদের কোম্পানিগুলোও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। আফ্রিকার বাজারে চীনা কোম্পানির দ্রুত অগ্রযাত্রা মোকাবিলা করতে জাপানি ব্র্যান্ডগুলো নতুন কৌশল নিয়েছে।

কেনিয়ার ই-বাইক বাজারে মুসাশি

মুসাশি সেইমিৎসু ইন্ডাস্ট্রি, দীর্ঘদিনের হোন্ডা মোটরের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী, কেনিয়ার স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ARC Ride-এর সঙ্গে মিলে নাইরোবিতে ই-বাইক চালু করেছে। ইতিমধ্যে তারা প্রায় ২০০টি ব্যাটারি স্টেশন স্থাপন করেছে যেখানে চালকরা প্রয়োজনমতো ব্যাটারি বদলাতে ও বিদ্যুতের খরচ মেটাতে পারেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার বাইক এসব স্টেশনের মাধ্যমে চালিত হচ্ছে। কোম্পানির লক্ষ্য ২০২৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছানো।

কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিরোশি ওতসুকা স্বীকার করেন, চীনা নির্মাতাদের তুলনায় দামে প্রতিযোগিতা অসম্ভব। তবে তিনি বলেন, মান ও বিক্রয়োত্তর সেবার মাধ্যমে বাজারে জায়গা পাওয়া সম্ভব। চীনা কোম্পানিগুলো সাধারণত শুধু পণ্য বিক্রিতে মনোযোগ দেয়, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব না দেওয়ায় অনেক গ্রাহক অসন্তুষ্ট হন। তবে ব্যাটারি প্রযুক্তিতে এখনো চীনারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

আফ্রিকায় চীনের প্রভাব

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আফ্রিকায় চীনের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫% বেড়ে ১২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন শুল্ক আরোপ ও স্থানীয় বাজারে চরম প্রতিযোগিতার কারণে চীনা কোম্পানিগুলো আফ্রিকাকে প্রধান বাজারে পরিণত করছে।

ইয়ামাহার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা

ইয়ামাহা মোটর ১৯৬০-এর দশক থেকে আফ্রিকায় ব্যবসা করছে। বাইকের বাজারে চীন ও ভারতের শক্ত অবস্থান থাকলেও ইয়ামাহার নৌযানের ইঞ্জিন এখনো শীর্ষ ব্র্যান্ড। কোম্পানির প্রতিনিধি মোটোকি ওয়াতানাবে জানান, ইয়ামাহা আফ্রিকার ৫০টিরও বেশি দেশে সার্ভিস সেন্টার, যন্ত্রাংশ সরবরাহ এবং স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত মেকানিক গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, নৌযানের ইঞ্জিনে মান ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সমস্যার ফলে সমুদ্রে দুর্ঘটনা প্রাণঘাতী হতে পারে।

তবে তিনি অভিযোগ করেন, বাজারে ইয়ামাহার নকল পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে চীনা নির্মাতারা মিঠাপানির নৌযানের জন্য সস্তা ইঞ্জিন সরবরাহ করে ইয়ামাহার বাজার দখল করছে। এসব ইঞ্জিন সাধারণত ২০% থেকে ৩০% সস্তা।

কৃষি যন্ত্রে কুবোটার সংগ্রাম

কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাতা কুবোটা আফ্রিকায় বিশেষত কম্বাইন হারভেস্টারের বাজারে চীনা প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। চীনা কোম্পানির মেশিন কুবোটার তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সস্তা। কুবোটা কেনিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিরোশি কানেকো বলেন, প্রথমে অনেকে সস্তার পণ্য কেনেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মান ও বিক্রয়োত্তর সেবা দেখে কুবোটার দিকে ফিরে আসেন। যদিও প্রতিযোগীরাও ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।

পানির অবকাঠামোয় জাপানি উদ্যোগ

জাপানের SK-Kawanishi কেনিয়ার পানির পাইপ সংযোগে নতুন প্রযুক্তি এনেছে, যা পানির অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। তাদের পণ্য ব্যবহারের পর লিকেজের হার ৫০% থেকে নেমে ১৪%-এ এসেছে। যদিও সরকারি টেন্ডারে তারা চীন ও ভারতের সস্তা সরবরাহকারীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট আকিহিরো কাওয়ানিশি বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের পণ্যই খরচ কমিয়ে দেয়।

চীনের বিপুল বিনিয়োগ বনাম জাপান

চীন গত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতি বছর আফ্রিকায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। ২০২৩ সালের শেষে আফ্রিকায় চীনের সরাসরি বিনিয়োগের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২.১১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২৪ সালে জাপানের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১.১৬ বিলিয়ন ডলার এবং মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৯.৭ বিলিয়ন ডলার, যা চীনের তুলনায় অনেক কম।

Daikin as a Model of Japanese Corporate Strength | JAPAN Forward

জাপানি কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি

TICAD সম্মেলনে জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, আফ্রিকার বাজার এখন চীনা কোম্পানিতে ভরপুর। এয়ারকন্ডিশনার ব্যবসায় ডাইকিন কোম্পানির বাজার অবস্থান নবম, যেখানে চীনা ও কোরিয়ান কোম্পানি এগিয়ে আছে। তারা দীর্ঘমেয়াদে শক্তি-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিয়ে বাজার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।

চীনকে অংশীদার হিসেবে দেখার চিন্তা

কিছু জাপানি উদ্যোক্তা মনে করেন, আফ্রিকার বিশাল বাজারে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সহযোগিতাও করা দরকার। সাংহাই-ভিত্তিক জাপানি ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি ইয়ো-রেনের চেয়ারম্যান ওসামু কানেদা বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনা কোম্পানির দক্ষতা কাজে লাগানো উচিত।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (JICA)-র প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা একই মত দেন। তিনি বলেন, আফ্রিকার জন্য জাপান ও চীনের ভিন্ন ভিন্ন খাতে সহায়তা দেওয়া উপকারী হতে পারে।

ইয়ামাহা মোটর, কুবোটা ও অন্যান্য জাপানি কোম্পানির আফ্রিকা পরিকল্পনা

০১:০০:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৫

আফ্রিকায় জাপান-চীন প্রতিযোগিতা

জাপান ও চীন সরকার যেমন আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, তেমনি তাদের কোম্পানিগুলোও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। আফ্রিকার বাজারে চীনা কোম্পানির দ্রুত অগ্রযাত্রা মোকাবিলা করতে জাপানি ব্র্যান্ডগুলো নতুন কৌশল নিয়েছে।

কেনিয়ার ই-বাইক বাজারে মুসাশি

মুসাশি সেইমিৎসু ইন্ডাস্ট্রি, দীর্ঘদিনের হোন্ডা মোটরের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী, কেনিয়ার স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ARC Ride-এর সঙ্গে মিলে নাইরোবিতে ই-বাইক চালু করেছে। ইতিমধ্যে তারা প্রায় ২০০টি ব্যাটারি স্টেশন স্থাপন করেছে যেখানে চালকরা প্রয়োজনমতো ব্যাটারি বদলাতে ও বিদ্যুতের খরচ মেটাতে পারেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার বাইক এসব স্টেশনের মাধ্যমে চালিত হচ্ছে। কোম্পানির লক্ষ্য ২০২৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছানো।

কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিরোশি ওতসুকা স্বীকার করেন, চীনা নির্মাতাদের তুলনায় দামে প্রতিযোগিতা অসম্ভব। তবে তিনি বলেন, মান ও বিক্রয়োত্তর সেবার মাধ্যমে বাজারে জায়গা পাওয়া সম্ভব। চীনা কোম্পানিগুলো সাধারণত শুধু পণ্য বিক্রিতে মনোযোগ দেয়, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব না দেওয়ায় অনেক গ্রাহক অসন্তুষ্ট হন। তবে ব্যাটারি প্রযুক্তিতে এখনো চীনারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

আফ্রিকায় চীনের প্রভাব

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আফ্রিকায় চীনের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫% বেড়ে ১২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন শুল্ক আরোপ ও স্থানীয় বাজারে চরম প্রতিযোগিতার কারণে চীনা কোম্পানিগুলো আফ্রিকাকে প্রধান বাজারে পরিণত করছে।

ইয়ামাহার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা

ইয়ামাহা মোটর ১৯৬০-এর দশক থেকে আফ্রিকায় ব্যবসা করছে। বাইকের বাজারে চীন ও ভারতের শক্ত অবস্থান থাকলেও ইয়ামাহার নৌযানের ইঞ্জিন এখনো শীর্ষ ব্র্যান্ড। কোম্পানির প্রতিনিধি মোটোকি ওয়াতানাবে জানান, ইয়ামাহা আফ্রিকার ৫০টিরও বেশি দেশে সার্ভিস সেন্টার, যন্ত্রাংশ সরবরাহ এবং স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত মেকানিক গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, নৌযানের ইঞ্জিনে মান ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সমস্যার ফলে সমুদ্রে দুর্ঘটনা প্রাণঘাতী হতে পারে।

তবে তিনি অভিযোগ করেন, বাজারে ইয়ামাহার নকল পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে চীনা নির্মাতারা মিঠাপানির নৌযানের জন্য সস্তা ইঞ্জিন সরবরাহ করে ইয়ামাহার বাজার দখল করছে। এসব ইঞ্জিন সাধারণত ২০% থেকে ৩০% সস্তা।

কৃষি যন্ত্রে কুবোটার সংগ্রাম

কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাতা কুবোটা আফ্রিকায় বিশেষত কম্বাইন হারভেস্টারের বাজারে চীনা প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। চীনা কোম্পানির মেশিন কুবোটার তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সস্তা। কুবোটা কেনিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিরোশি কানেকো বলেন, প্রথমে অনেকে সস্তার পণ্য কেনেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মান ও বিক্রয়োত্তর সেবা দেখে কুবোটার দিকে ফিরে আসেন। যদিও প্রতিযোগীরাও ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।

পানির অবকাঠামোয় জাপানি উদ্যোগ

জাপানের SK-Kawanishi কেনিয়ার পানির পাইপ সংযোগে নতুন প্রযুক্তি এনেছে, যা পানির অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। তাদের পণ্য ব্যবহারের পর লিকেজের হার ৫০% থেকে নেমে ১৪%-এ এসেছে। যদিও সরকারি টেন্ডারে তারা চীন ও ভারতের সস্তা সরবরাহকারীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট আকিহিরো কাওয়ানিশি বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের পণ্যই খরচ কমিয়ে দেয়।

চীনের বিপুল বিনিয়োগ বনাম জাপান

চীন গত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতি বছর আফ্রিকায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। ২০২৩ সালের শেষে আফ্রিকায় চীনের সরাসরি বিনিয়োগের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২.১১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২৪ সালে জাপানের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১.১৬ বিলিয়ন ডলার এবং মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৯.৭ বিলিয়ন ডলার, যা চীনের তুলনায় অনেক কম।

Daikin as a Model of Japanese Corporate Strength | JAPAN Forward

জাপানি কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি

TICAD সম্মেলনে জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, আফ্রিকার বাজার এখন চীনা কোম্পানিতে ভরপুর। এয়ারকন্ডিশনার ব্যবসায় ডাইকিন কোম্পানির বাজার অবস্থান নবম, যেখানে চীনা ও কোরিয়ান কোম্পানি এগিয়ে আছে। তারা দীর্ঘমেয়াদে শক্তি-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিয়ে বাজার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।

চীনকে অংশীদার হিসেবে দেখার চিন্তা

কিছু জাপানি উদ্যোক্তা মনে করেন, আফ্রিকার বিশাল বাজারে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সহযোগিতাও করা দরকার। সাংহাই-ভিত্তিক জাপানি ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি ইয়ো-রেনের চেয়ারম্যান ওসামু কানেদা বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনা কোম্পানির দক্ষতা কাজে লাগানো উচিত।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (JICA)-র প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা একই মত দেন। তিনি বলেন, আফ্রিকার জন্য জাপান ও চীনের ভিন্ন ভিন্ন খাতে সহায়তা দেওয়া উপকারী হতে পারে।