০২:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভিন্ন মনের বৈচিত্র্য বোঝা

ভূমিকা

মানবমস্তিষ্কের গঠন এক নয়। শেখার পদ্ধতি, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও আচরণে এই বৈচিত্র্যই তৈরি করে নিউরোডাইভার্জেন্স। এটি কোনো রোগ নয়, বরং মানব বৈচিত্র্যেরই একটি অংশ। তবে এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক সময় মিশে যায়, যা বিভ্রান্তি ও কলঙ্ক বাড়ায়।

সিঙ্গাপুরে প্রচলিত নিউরোডাইভার্জেন্স

সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD), এরপর অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD)।

  • অনুমান করা হয়, ৫-৮ শতাংশ শিশু ADHD-তে আক্রান্ত।
  • প্রায় ১ শতাংশ শিশু ASD-তে ভোগে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১,২০০ জন ADHD রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের ৮২ শতাংশের বয়স ছিল ২১ বছরের নিচে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: এড্রিয়ানের গল্প

৪৮ বছর বয়সী শিক্ষক এড্রিয়ান শৈশব থেকেই আলাদা বোধ করতেন। তার অটিজম, ডাইস্প্রাক্সিয়া ও ডিসক্যালকুলিয়া ধরা পড়ে ১৮ বছর বয়সে।

  • অটিজমের কারণে সামাজিক সংকেত বুঝতে সমস্যা হতো।
  • ডাইস্প্রাক্সিয়ায় তিনি অগোছালো ও অদক্ষ মনে হতো।
  • ডিসক্যালকুলিয়ার কারণে সংখ্যার সঙ্গে কাজ করতে পারতেন না।

স্কুল ও সেনা জীবনে সহপাঠীদের উপহাস সয়েছেন। কর্মজীবনে দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিবেশে তিনি হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন এবং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। তার মতে, অদৃশ্য সমস্যাগুলোকে সমাজ সহজে মেনে নেয় না।

নিউরোডাইভার্জেন্স বনাম মানসিক স্বাস্থ্য

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সেলিন ওয়ং ব্যাখ্যা করেন:

  • নিউরোডাইভার্জেন্স হলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ভিন্নতা। যেমন: অটিজম, ADHD, ডিসলেক্সিয়া।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলো অসুস্থতা। যেমন: ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার।

অতীতে নিউরোডাইভার্জেন্সকে রোগ হিসেবে দেখা হতো। এখন এটিকে মানব বৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে:

  • ৮০% অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।
  • ৩৫-৫০% ADHD আক্রান্ত ব্যক্তি ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটিতে ভোগেন।

কীভাবে চেনা যায় নিউরোডাইভার্জেন্স?

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইউজিন খেং জানান, ভাষা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বা শারীরিক দক্ষতার বিকাশে বিলম্ব হলে সচেতন হতে হবে। তবে সব সময় লক্ষণ স্পষ্ট নাও হতে পারে।

বিশেষত মেয়েদের ADHD প্রায়ই ধরা পড়ে না। তাদের মধ্যে অমনোযোগ ও দিবাস্বপ্নময় আচরণ বেশি দেখা যায়, যা ‘অগোছালো’ বা ‘অলস’ বলে ভুল বোঝা হয়।

শেরিলের অভিজ্ঞতা

টেক খাতে কর্মরত ২৫ বছর বয়সী শেরিল কিশোর বয়সে ডিপ্রেশনের কারণে ভর্তি হলে ADHD ধরা পড়ে।

  • হঠাৎ সিদ্ধান্তে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া, সমালোচনায় সংবেদনশীলতা ইত্যাদি কারণে ডাক্তার পরীক্ষা করান।
  • তার ADHD-এর সঙ্গে ছিল রিজেকশন-সেনসিটিভ ডিসফোরিয়া, যা প্রত্যাখ্যান থেকে গভীর মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।

ডায়াগনোসিসের পর তিনি নিজের মূল্য বোঝেন, সীমারেখা তৈরি করেন এবং বর্তমানে ওষুধ সেবন করে পড়াশোনা ও কাজ সামলাচ্ছেন।

অটিজম স্পেকট্রাম বোঝা

ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ (IMH)-এর ডা. সাং মিন বলেন, অটিজমকে ‘স্পেকট্রাম’ বলা হয় কারণ প্রত্যেকের মধ্যে উপসর্গ ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।

  • সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা,
  • বারবার একরকম আচরণ,
  • সীমিত আগ্রহ— এগুলো মূল বৈশিষ্ট্য।

তবে হস্তক্ষেপ ও সহায়তায় পরিবর্তন সম্ভব। যেমন, শিশুদের থেরাপি ও স্কুলে সহায়তা ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা রাখে।

রে-এর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন

১৯ বছর বয়সী রে-এর জিয়া রুই অটিজমে আক্রান্ত হলেও চীনা ভাষার প্রতি গভীর আগ্রহ থেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

  • তিন বছর বয়সে অটিজম ধরা পড়ে।
  • সময়মতো থেরাপি ও স্কুল সহায়তায় ধীরে ধীরে সামাজিক দক্ষতা বাড়ে।
  • এনজি অ্যান পলিটেকনিক থেকে চীনা স্টাডিজে ডিপ্লোমা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বৃত্তি পান।

তার বাবা জানান, অটিজম আক্রান্তদের সামাজিক দক্ষতা শেখার বিষয় হলেও তারা পড়াশোনা ও কাজে ভালো করতে পারে।

এলেনা হোর গল্প: মা থেকে সাইকোথেরাপিস্ট

এলেনা হো নিজের মেয়ের উপসর্গ দেখে ৪৯ বছর বয়সে ADHD পরীক্ষা করান এবং নিজেরও ADHD ধরা পড়ে।

  • তিনি বলেন, ডায়াগনোসিস তাকে বোঝাতে সাহায্য করেছে যে সমস্যা মস্তিষ্কের ভিন্নতার কারণে, ব্যক্তিত্বের ত্রুটির কারণে নয়।
  • তার স্বামীও ADHD আক্রান্ত, এবং পরিবারের এই বোঝাপড়া সম্পর্ক উন্নত করেছে।

এখন তিনি নিজেই সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেন এবং ADHD-তে আক্রান্ত মানুষদের বোঝার চেষ্টা করেন।

নিউরোডাইভার্জেন্স কোনো ত্রুটি নয়, বরং বৈচিত্র্য। তবে এর সঙ্গে জড়িত ভুল ধারণা, সামাজিক চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মানুষের জীবন কঠিন করে তোলে। সচেতনতা, প্রাথমিক হস্তক্ষেপ, সঠিক সহায়তা এবং বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই নিউরোডাইভার্জেন্ট ব্যক্তিরা সমাজে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

ভিন্ন মনের বৈচিত্র্য বোঝা

১১:০২:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৫

ভূমিকা

মানবমস্তিষ্কের গঠন এক নয়। শেখার পদ্ধতি, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও আচরণে এই বৈচিত্র্যই তৈরি করে নিউরোডাইভার্জেন্স। এটি কোনো রোগ নয়, বরং মানব বৈচিত্র্যেরই একটি অংশ। তবে এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক সময় মিশে যায়, যা বিভ্রান্তি ও কলঙ্ক বাড়ায়।

সিঙ্গাপুরে প্রচলিত নিউরোডাইভার্জেন্স

সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD), এরপর অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD)।

  • অনুমান করা হয়, ৫-৮ শতাংশ শিশু ADHD-তে আক্রান্ত।
  • প্রায় ১ শতাংশ শিশু ASD-তে ভোগে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১,২০০ জন ADHD রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের ৮২ শতাংশের বয়স ছিল ২১ বছরের নিচে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: এড্রিয়ানের গল্প

৪৮ বছর বয়সী শিক্ষক এড্রিয়ান শৈশব থেকেই আলাদা বোধ করতেন। তার অটিজম, ডাইস্প্রাক্সিয়া ও ডিসক্যালকুলিয়া ধরা পড়ে ১৮ বছর বয়সে।

  • অটিজমের কারণে সামাজিক সংকেত বুঝতে সমস্যা হতো।
  • ডাইস্প্রাক্সিয়ায় তিনি অগোছালো ও অদক্ষ মনে হতো।
  • ডিসক্যালকুলিয়ার কারণে সংখ্যার সঙ্গে কাজ করতে পারতেন না।

স্কুল ও সেনা জীবনে সহপাঠীদের উপহাস সয়েছেন। কর্মজীবনে দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিবেশে তিনি হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন এবং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। তার মতে, অদৃশ্য সমস্যাগুলোকে সমাজ সহজে মেনে নেয় না।

নিউরোডাইভার্জেন্স বনাম মানসিক স্বাস্থ্য

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সেলিন ওয়ং ব্যাখ্যা করেন:

  • নিউরোডাইভার্জেন্স হলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ভিন্নতা। যেমন: অটিজম, ADHD, ডিসলেক্সিয়া।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলো অসুস্থতা। যেমন: ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার।

অতীতে নিউরোডাইভার্জেন্সকে রোগ হিসেবে দেখা হতো। এখন এটিকে মানব বৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে:

  • ৮০% অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।
  • ৩৫-৫০% ADHD আক্রান্ত ব্যক্তি ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটিতে ভোগেন।

কীভাবে চেনা যায় নিউরোডাইভার্জেন্স?

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইউজিন খেং জানান, ভাষা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বা শারীরিক দক্ষতার বিকাশে বিলম্ব হলে সচেতন হতে হবে। তবে সব সময় লক্ষণ স্পষ্ট নাও হতে পারে।

বিশেষত মেয়েদের ADHD প্রায়ই ধরা পড়ে না। তাদের মধ্যে অমনোযোগ ও দিবাস্বপ্নময় আচরণ বেশি দেখা যায়, যা ‘অগোছালো’ বা ‘অলস’ বলে ভুল বোঝা হয়।

শেরিলের অভিজ্ঞতা

টেক খাতে কর্মরত ২৫ বছর বয়সী শেরিল কিশোর বয়সে ডিপ্রেশনের কারণে ভর্তি হলে ADHD ধরা পড়ে।

  • হঠাৎ সিদ্ধান্তে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া, সমালোচনায় সংবেদনশীলতা ইত্যাদি কারণে ডাক্তার পরীক্ষা করান।
  • তার ADHD-এর সঙ্গে ছিল রিজেকশন-সেনসিটিভ ডিসফোরিয়া, যা প্রত্যাখ্যান থেকে গভীর মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।

ডায়াগনোসিসের পর তিনি নিজের মূল্য বোঝেন, সীমারেখা তৈরি করেন এবং বর্তমানে ওষুধ সেবন করে পড়াশোনা ও কাজ সামলাচ্ছেন।

অটিজম স্পেকট্রাম বোঝা

ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ (IMH)-এর ডা. সাং মিন বলেন, অটিজমকে ‘স্পেকট্রাম’ বলা হয় কারণ প্রত্যেকের মধ্যে উপসর্গ ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।

  • সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা,
  • বারবার একরকম আচরণ,
  • সীমিত আগ্রহ— এগুলো মূল বৈশিষ্ট্য।

তবে হস্তক্ষেপ ও সহায়তায় পরিবর্তন সম্ভব। যেমন, শিশুদের থেরাপি ও স্কুলে সহায়তা ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা রাখে।

রে-এর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন

১৯ বছর বয়সী রে-এর জিয়া রুই অটিজমে আক্রান্ত হলেও চীনা ভাষার প্রতি গভীর আগ্রহ থেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

  • তিন বছর বয়সে অটিজম ধরা পড়ে।
  • সময়মতো থেরাপি ও স্কুল সহায়তায় ধীরে ধীরে সামাজিক দক্ষতা বাড়ে।
  • এনজি অ্যান পলিটেকনিক থেকে চীনা স্টাডিজে ডিপ্লোমা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বৃত্তি পান।

তার বাবা জানান, অটিজম আক্রান্তদের সামাজিক দক্ষতা শেখার বিষয় হলেও তারা পড়াশোনা ও কাজে ভালো করতে পারে।

এলেনা হোর গল্প: মা থেকে সাইকোথেরাপিস্ট

এলেনা হো নিজের মেয়ের উপসর্গ দেখে ৪৯ বছর বয়সে ADHD পরীক্ষা করান এবং নিজেরও ADHD ধরা পড়ে।

  • তিনি বলেন, ডায়াগনোসিস তাকে বোঝাতে সাহায্য করেছে যে সমস্যা মস্তিষ্কের ভিন্নতার কারণে, ব্যক্তিত্বের ত্রুটির কারণে নয়।
  • তার স্বামীও ADHD আক্রান্ত, এবং পরিবারের এই বোঝাপড়া সম্পর্ক উন্নত করেছে।

এখন তিনি নিজেই সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেন এবং ADHD-তে আক্রান্ত মানুষদের বোঝার চেষ্টা করেন।

নিউরোডাইভার্জেন্স কোনো ত্রুটি নয়, বরং বৈচিত্র্য। তবে এর সঙ্গে জড়িত ভুল ধারণা, সামাজিক চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মানুষের জীবন কঠিন করে তোলে। সচেতনতা, প্রাথমিক হস্তক্ষেপ, সঠিক সহায়তা এবং বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই নিউরোডাইভার্জেন্ট ব্যক্তিরা সমাজে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।