শেয়ারবাজারে নতুন চমক
চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারবাজার সাধারণত হতাশার জায়গা। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির শেয়ারবাজার বিশ্বমানের তুলনায় পিছিয়ে থাকে, ফলে অনেকে আমেরিকা বা জাপানের বাজারে বিনিয়োগের পথ খুঁজতে থাকে। কিন্তু ২০২৫ সালে পরিস্থিতি আলাদা। ২৫ আগস্ট সাংহাই কম্পোজিট সূচক দশ বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। ডলারের হিসেবে বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এটি ১৭ শতাংশ বেড়েছে, যা আমেরিকার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ কিংবা বৈশ্বিক সূচকের চেয়েও বেশি।
অর্থনীতির মন্দা, কোম্পানিগুলোর চাপ
অন্যদিকে চীনের অর্থনীতি ভুগছে অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার সমস্যায়। একই বাজারে অসংখ্য কোম্পানির প্রতিযোগিতা দাম কমিয়ে দিচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে সৌরশক্তি—সব খাতেই এই সংকট। চীনের সবচেয়ে সফল ইভি কোম্পানি বিওয়াইডি-ও (BYD) সরবরাহকারীদের অর্থ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বছরের প্রথম ছয় মাসে শীর্ষ সৌরশক্তি কোম্পানিগুলোর লোকসান বেড়েছে। সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত—খাবার সরবরাহকারীরা মূল্যযুদ্ধে ফেঁসে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রের উদ্যোগ ও আশাবাদ
এমন বাস্তবতায় শেয়ারবাজারের উত্থান কিছুটা অস্বস্তিকর। বছরজুড়ে সরকার ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয় স্টার্টআপ ডিপসিক (DeepSeek)-এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্য, কিংবা দেশীয় অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র “নে ঝা ২”-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের “অ্যান্টি ইনভলিউশন” অভিযান, অর্থাৎ অতিরিক্ত সরবরাহ কমানোর উদ্যোগকেও বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নতুন প্রণোদনার উৎস
রপ্তানিমুখী শিল্প খাত ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যিক চাপের মাঝেও প্রত্যাশার চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২৫ আগস্ট সাংহাই নগর কর্তৃপক্ষ আবাসন ক্রয়ে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করেছে, যা সম্পত্তির বাজারকে উষ্ণ করতে পারে। পরিবারগুলো বিশাল সঞ্চয় থেকে কিছু অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। কোম্পানিগুলোও নিজস্ব শেয়ার কিনছে—এ বছর প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ইউয়ান পুনঃক্রয় করেছে। বীমা কোম্পানিগুলোও রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে—মাত্র ছয় মাসে ৬২০ বিলিয়ন ইউয়ান, যা গত বছরের পুরো বিনিয়োগের প্রায় সমান।
অর্থনৈতিক বাস্তবতার বিপরীতে বাজার
কখনো কখনো মনে হয় শেয়ারবাজার বাস্তবতার বাইরে চলেছে। ১৫ আগস্ট প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা যায় ভোক্তা ব্যয়, শিল্প উৎপাদন এবং স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কমেছে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় শেয়ারবাজার পড়েনি, বরং সাংহাই সূচক ১ শতাংশ বেড়েছে।
কোম্পানির লোকসান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
এ বছর প্রথম ছয় মাসের আয় প্রকাশ করা মূল ভূখণ্ডের ২৩ শতাংশ কোম্পানি লোকসান দেখিয়েছে—২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চ হার। কোভিড-পূর্ব সময়ে এই হার ছিল ১০ শতাংশেরও কম। আরও কোম্পানি শিগগিরই প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, তবে ইতিবাচক ধারার কোনো ইঙ্গিত নেই।
নীতিগত সীমাবদ্ধতা
সরকারের সংস্কারমূলক উদ্যোগগুলোও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে পারে। চীনের শিল্পনীতি দীর্ঘদিন ধরে বড় ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল, যা প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দাম নামিয়ে আনে। এ কারণেই চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক সস্তা। এই নীতির পরিবর্তন মানে দুর্বল কোম্পানিগুলোর পতন এবং বেকারত্বের ঝুঁকি, যা সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। ফলে সর্বত্র এই পরিবর্তন ঘটবে—এমনটা সম্ভব নয়।
উদ্বেগ ও সতর্ক সংকেত
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা তাই চিন্তিত। এক ফান্ড ম্যানেজার বলছেন, তরল অর্থ থাকলে দাম আরও বাড়তে পারে, তবে এটি ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।এইচএসবিসির বিশ্লেষকেরা মন্তব্য করেছেন, “এই উত্থান বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন মনে হচ্ছে।” এমনকি সরকারও শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। ২৭ আগস্ট গুজব ছড়ায় যে সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সামাজিক মাধ্যমে “বুল মার্কেট” শব্দের ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আনছে।
সব মিলিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—চীনের এই শেয়ারবাজারের উত্থান কি টিকবে, নাকি শিগগিরই বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যাবে?