বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে নেওয়া বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ (বিডিপি ২১০০) বাস্তবায়নের জন্য বার্ষিক ব্যয় অন্তত তিনগুণ বাড়াতে হবে।
বর্তমান ব্যয় ও প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি
সরকার বর্তমানে ডেল্টা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ০.৮ শতাংশ ব্যয় করছে। অথচ ৮০টি অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এ ব্যয় বাড়িয়ে অন্তত ২.৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে বলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু অর্থায়ন বাজেট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর লক্ষ্য
২০১৮ সালে অনুমোদিত এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, খাদ্য ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দুর্যোগ মোকাবিলা করা।
এতে ৩টি জাতীয় লক্ষ্য ও ৬টি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য ৬টি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে— উপকূলীয় এলাকা, বরেন্দ্র ও খরা-প্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং শহরাঞ্চল।
অগ্রাধিকার প্রকল্প ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা
প্রথম পর্যায়ের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ২০৪০ সাল পর্যন্ত। এর আওতায় সরকার ৮০টি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়েছে— ৬৫টি অবকাঠামোগত এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও গবেষণামূলক।
সরকারি নথি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য-পানি নিরাপত্তা ও দুর্যোগ প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনাটি তিন ধাপে বাস্তবায়ন হবে— স্বল্পমেয়াদি (২০৩০ পর্যন্ত), মধ্যমেয়াদি (২০৫০ পর্যন্ত) ও দীর্ঘমেয়াদি (২১০০ পর্যন্ত)।
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ও চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দিতে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) গঠন করা হয়। বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক সংস্থার মাধ্যমে কিছু অর্থ পেলেও সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাওয়া এখনো বিরল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, জিসিএফ-এর শর্তগুলো দেশের সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এ শর্ত পূরণ করতে না পারলে বাংলাদেশ অর্থ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এ জন্য বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থার আলোকে শর্ত পুনর্বিবেচনা জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশে জিসিএফ-এর ৮টি প্রকল্প চলছে। এসব প্রকল্পের মোট অর্থায়ন ৬১৯.২৩ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৬৪.৮৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান, ২৯০ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং বাকি ১৬৪.৮৬ মিলিয়ন ডলার সরকারি সহ-অর্থায়ন হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার জিসিএফ থেকে পেতে চায়, আর বাকি অর্থ আসবে উন্নয়ন সহযোগী, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাত থেকে।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা
বিডিপি ২১০০ অনুযায়ী, বেসরকারি খাতও বছরে জিডিপির প্রায় ০.৫ শতাংশ অর্থ দিতে পারে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৮০ প্রকল্পের মধ্যে ৩৪টি জলবায়ু অর্থায়নের আওতাভুক্ত। এর মধ্যে ঢাকা শহরের চারপাশের নদীর পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনঃস্থাপন প্রকল্পটি জলবায়ু অর্থায়ন ও বেসরকারি খাত উভয়ের জন্যই বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে।
কোন অঞ্চলে বেশি গুরুত্ব
সরকার মূলত উপকূলীয়, নদী ও শহরাঞ্চলে সহনশীলতা বাড়াতে গুরুত্ব দিয়েছে।
- উপকূলীয় অঞ্চলে ২৩টির মধ্যে ১৩টি প্রকল্প জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সঙ্গে সম্পর্কিত— এগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় কেন্দ্রীভূত।
- নদী ও মোহনা অঞ্চলে ৭টির মধ্যে ৫টি প্রকল্প ভাঙন ও বন্যা ঝুঁকি কমাতে নেওয়া হয়েছে।
- শহরাঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে ৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে জলাবদ্ধতা, দূষণ ও নদী পুনঃস্থাপনে।
- হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকায় ৬টির মধ্যে ৪টি জলবায়ু-সম্পর্কিত।
তবে বরেন্দ্র ও খরা-প্রবণ এলাকায় কোনো জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্প নেই, যদিও এসব অঞ্চল পানি সংকট ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে শুধু সরকারের অর্থ বরাদ্দ নয়, বরং আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল, উন্নয়ন সহযোগী এবং বেসরকারি খাতের অবদানও অপরিহার্য। বিশেষ করে খরা-প্রবণ অঞ্চলগুলোকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।