দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বরাবরই ভারতের কৌশলগত স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বিশেষত নিম্ন মেকং অঞ্চলের দেশগুলো ও আসিয়ান জোটের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ভেতরে দ্বন্দ্ব, সীমান্তসংঘাত এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই ভারসাম্যকে নাড়া দিচ্ছে।
ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট” নীতি আসিয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর কৌশল হলেও মিয়ানমারের সংকট, কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড উত্তেজনা এবং চীনের বিআরআই উদ্যোগ দিল্লির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
মিয়ানমার: সংকটে জর্জরিত প্রতিবেশী
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চি সরকারের পতনের পর দেশটি মানবিক ও রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে—শরণার্থী প্রবাহ, বিদ্রোহী কার্যকলাপ, মাদক ও অবৈধ বাণিজ্যের বিস্তার সীমান্ত নিরাপত্তা নীতিতে চাপ তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, মিয়ানমার এখন চীনের জন্য রেয়ার আর্থ উপাদানের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার টনের বেশি রেয়ার আর্থ চীনে রপ্তানি হয়েছে, যার বড় অংশই অভ্যুত্থানের পর। এই খনিজ সরবরাহ চীনের আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা খনন কার্যক্রম আঞ্চলিক পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড: পুরোনো দ্বন্দ্বে নতুন আগুন
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সম্পর্ক বহুদিনের দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের টানাপোড়েনে জর্জরিত। ২০০৮ সালে প্রেহ ভিহেয়ার মন্দির নিয়ে সংঘাত তার বড় উদাহরণ। বর্তমানে উত্তেজনার কেন্দ্র গালফ অব থাইল্যান্ডের সামুদ্রিক সীমানা, যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২৫ সালে সীমান্তে কয়েক দফা সংঘর্ষে হতাহত ও বাস্তুচ্যুত মানুষের ঘটনা ঘটেছে। জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা ও দুর্বল কূটনীতি এ বিরোধকে আরও জটিল করে তুলছে। এর ফলে আসিয়ানের ঐক্য ভঙ্গুর হয়ে উঠছে, যা বহিরাগত শক্তির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ বাড়াচ্ছে।
বিআরআই-এর বিস্তার: চীনের হাত প্রসারিত
নিম্ন মেকং অঞ্চলে লাওস ও কম্বোডিয়া প্রায় পুরোপুরি চীনের বিআরআই কাঠামোর অংশ হয়ে গেছে। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারও বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত, যদিও বাস্তবায়নে নানা জটিলতা রয়েছে।
চীন মিয়ানমারের সামরিক শাসনকে বিনিয়োগ, অস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে শক্তিশালী করছে। মিউজ-মান্দালে রেলপথ ও কিয়াউকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর তাদের মূল প্রকল্প, যা চীনকে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।

কম্বোডিয়াও চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তারা যৌথভাবে ১.২ বিলিয়ন ডলারের ফুনান তেচ্ছো খাল নির্মাণ করছে, যা ফনম পেনকে গালফ অব থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করবে। ভিয়েতনামের আশঙ্কা, এতে মেকং ডেল্টার পানিপ্রবাহ কমে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। পাশাপাশি কম্বোডিয়ার রিয়াম নৌঘাঁটি সম্প্রসারণেও চীন সক্রিয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রকল্প চীনকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জ্বালানি রুটে আরও শক্ত অবস্থান এনে দেবে।
ভারতের জন্য বাড়তি চাপ
দিল্লি চাইছে আসিয়ানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। কিন্তু মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর চীননির্ভরতা আঞ্চলিক ঐক্য দুর্বল করছে। দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতেও ভিন্ন অবস্থান পরিস্থিতি জটিল করছে। ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন বাধ্যতামূলক কোড অব কন্ডাক্ট (আচরণবিধি) দাবি করছে, অথচ কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমার চীনের স্বার্থ রক্ষায় সতর্ক ভঙ্গি নিয়েছে।
চীন “চায়না-আসিয়ান কমিউনিটি উইথ আ শেয়ার্ড ফিউচার” ধারণা সামনে এনে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। এতে আসিয়ানের কেন্দ্রীয় ভূমিকাও ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। মেকং অঞ্চলে চীনের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী হওয়ায় বঙ্গোপসাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

ভারতের করণীয়
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির এক দশক পূর্ণ হয়েছে ২০২৪ সালে। আগামী দশকে দিল্লিকে মেকং দেশগুলোর সঙ্গে আরও গভীর কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মেকং-গঙ্গা সহযোগিতায় সক্রিয় ভূমিকা রাখলে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব।
বিশেষ করে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে চীন পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। পাশাপাশি ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার জরুরি, বিশেষত রেয়ার আর্থ খনিজ খাতে। ভিয়েতনাম এ খাতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ সম্ভাবনাময় দেশ এবং চীনের আধিপত্য মোকাবিলায় সক্রিয়। একইসঙ্গে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সামরিক অবকাঠামো উন্নয়ন ভারতের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















