আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ সরাসরি দেশে
বাংলাদেশে স্বর্ণের দামের ওঠানামা দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য আলোচনার বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর দাম দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে জুয়েলারি ব্যবসায়ীরাও চাপে পড়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা।
বিশ্ববাজারে যখনই স্বর্ণের দাম বাড়ে, তার প্রভাব কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের বাজারে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো বড় বাজারগুলোতে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ খাত থেকে সরে এসে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। ফলে বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
ডলারের বিনিময় হার: বাড়তি চাপ
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া। বাংলাদেশ স্বর্ণের সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর একটি দেশ। ফলে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারই নির্ভরতার মূল। সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিনিময় হার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় একই পরিমাণ স্বর্ণ কিনতে এখন ব্যবসায়ীদের অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) একাধিক নেতা জানান, গত দুই বছরে টাকার অবমূল্যায়নের সরাসরি প্রভাব পড়েছে স্বর্ণের দামে। আগে যে স্বর্ণ আমদানি করতে ৮০ টাকা দরে ডলার কিনতে হতো, এখন সেটি ছাড়িয়েছে ১২০ টাকার ওপরে।
মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও স্বর্ণের দামের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে। চলমান মুদ্রাস্ফীতি, বাড়তি আমদানি ব্যয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ যখন টাকার ভবিষ্যৎ মূল্য নিয়ে সন্দিহান হন, তখন তারা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণ কিনে রাখেন।
এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মতামত, দেশে মুদ্রাস্ফীতি যত বেশি হবে, মানুষ তত বেশি বিকল্প নিরাপদ সম্পদ খুঁজবে। স্বর্ণের বাজারে এ ধরনের মানসিকতার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ফলে চাহিদা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
সরবরাহ ঘাটতি ও নীতিগত জটিলতা
বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। অনেক সময় নীতিগত অনুমতি, শুল্ক কাঠামো ও কাগজপত্রের জটিলতার কারণে পর্যাপ্ত স্বর্ণ আমদানি সম্ভব হয় না। এতে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়।
যখন বাজারে সরবরাহ কমে যায় অথচ চাহিদা অপরিবর্তিত থাকে কিংবা বেড়ে যায়, তখন দাম বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদা পূরণের মতো স্বর্ণ আনতে গেলে প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও করের চাপ হ্রাস করা প্রয়োজন।
স্থানীয় বাজারের প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা
বাংলাদেশের জুয়েলারি বাজারে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম ওঠানামা করলেও অনেক সময় স্থানীয় বাজারের প্রভাব আরও বড় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বিয়ের মৌসুম, উৎসব কিংবা বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠানের সময়ে চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়।
তবে বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দামের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি কেবল চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নয়; ব্যবসায়ীদের মধ্যকার কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবও দায়ী। প্রতিযোগিতা না থাকায় অনেক সময় একতরফাভাবে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
সাধারণ মানুষের কষ্ট
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা। বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে এখনও স্বর্ণের ব্যবহার অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে নকশায় ছোট স্বর্ণালঙ্কার বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন বা বিকল্প হিসেবে স্বর্ণের পরিবর্তে হালকা সোনালি রঙের অলঙ্কারে ঝুঁকছেন।
একজন ক্রেতা জানান, “আগে যে গহনা বানাতে ৫০ হাজার টাকা লাগত, এখন সেটি ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায় না। আমাদের মতো পরিবারের জন্য এটি বিশাল চাপ।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অর্থনীতিবিদদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না হলে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান না বাড়লে নিকট ভবিষ্যতে স্বর্ণের দাম কমার সম্ভাবনা কম। তবে স্বচ্ছ আমদানি নীতি, কর কাঠামোর সংস্কার এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো গেলে দামের ঊর্ধ্বমুখী চাপ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উভয় কারণই সমানভাবে কাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, সরবরাহ ঘাটতি এবং বাজারের প্রতিযোগিতাহীনতা একে আরও জটিল করছে। তাই স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে শুধু আন্তর্জাতিক বাজার নয়, বরং দেশের ভেতরেও সুশৃঙ্খল নীতি ও কার্যকর বাজারব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।