০১:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আমি আগে, আমরা পরে: সমাজে হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমের উত্থান

আজকের বিশ্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা, আত্ম-উপলব্ধি ও নিজস্ব সত্য খোঁজার ওপর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব দিচ্ছে। সুস্থ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানুষকে নিজস্ব বিকাশের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত রাখে। কিন্তু যখন এই প্রবণতা চরমে পৌঁছে যায়, তখন তা রূপ নেয় হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমে — যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ, আরাম আর স্বপ্নের জায়গা পায় সমাজ ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব।

হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম কী

হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম মূলত সেই মানসিকতা যেখানে সমাজ বা অন্যদের প্রয়োজনকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়। ব্যক্তিগত সাফল্য ও সন্তুষ্টিই হয়ে ওঠে চূড়ান্ত লক্ষ্য। এর প্রভাবে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি হওয়া এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে বহুজাতিক সংস্কৃতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দ্রুত আধুনিকায়নের মধ্যে এই প্রবণতা কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মানুষ তাদের মতামত জানিয়েছেন।

High costs a barrier to mental health support in UAE, report finds | The  National

নিজেকে আগে রাখার মানসিকতা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ‘youvegotthis.ae’ এর ক্যাট বলেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এক ধরনের চরম রূপ। আজ মানুষ নিজেদের শক্তি রক্ষা, সীমা নির্ধারণ এবং স্বপ্নপূরণে এতটাই মনোযোগী যে সম্পর্কের জটিলতা বা পারস্পরিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

তিনি জানান, বন্ধুত্বেও এখন দেখা যাচ্ছে “কুইয়েট কুইটিং” — কোনো বড় দ্বন্দ্ব ছাড়াই দীর্ঘদিনের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ, পরিবারের ভাঙন ও শহুরে জীবনের একাকিত্ব এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

ভারসাম্যের প্রয়োজন

দুবাইয়ের হেরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিওনা রবসন বলেন, সবকিছুই পরিস্থিতি নির্ভর। কর্মক্ষেত্রে টিমওয়ার্ক জরুরি হলেও অনেকেই কেবল ব্যক্তিগত লক্ষ্য নিয়েই ব্যস্ত। তাই শিক্ষা ও কর্মজীবনে দলগত কাজের মূল্যায়ন জরুরি।

তার মতে, ম্যানেজার ও নিয়োগকর্তাদের দায়িত্ব হলো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ক্ষতিকর হতে পারে তা চিহ্নিত করা এবং সমষ্টিগত দায়িত্বের নিয়ম পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা।

সামাজিক বন্ধন ভাঙনের ঝুঁকি

দুবাই-ভিত্তিক ব্যবসায়ী সিন্ধু বিজু মনে করেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম মানুষের বিবর্তনের শুরু থেকেই ছিল, তবে সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতামূলক যুগে এটি আরও বেড়েছে। এর ফলে সমাজে সমষ্টিগত মঙ্গল উপেক্ষিত হচ্ছে।

Individualistic Practices and Values Increasing Around the World –  Association for Psychological Science – APS

তবে তিনি বলেন, সংকটকাল যেমন কোভিড-১৯ মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ আবারও একত্রিত হয়। অর্থাৎ সঠিকভাবে মোকাবিলা করলে এ প্রবণতা সামলানো সম্ভব।

আশার আলো

দুবাই-ভিত্তিক মার্কেটিং পেশাজীবী অর্ণব ঘোষ মনে করেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম শহুরে জীবনের অংশ, তবে পরিস্থিতি সবসময় অন্ধকার নয়। তিনি বলেন, মানুষের জীবনে এখনও বন্ধু ও সমাজের জায়গা আছে, যদিও তা ব্যক্তিগত সুবিধার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

অর্ণব মনে করেন, অনেক ঐতিহাসিক উদ্ভাবন — যেমন স্টিভ জবসের অ্যাপল গড়ে তোলা — হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমের ফল। ব্যক্তিগত দৃষ্টি ও দৃঢ়তা অনেক সময় সমাজকেই এগিয়ে নেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, যা অনেককে আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সমষ্টিগত দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াই টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

অবশেষে, অগ্রগতি সম্ভব তখনই যখন ব্যক্তি বিকাশ ও সামাজিক সংহতি একসঙ্গে এগোয়।

আমি আগে, আমরা পরে: সমাজে হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমের উত্থান

০৫:০০:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আজকের বিশ্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা, আত্ম-উপলব্ধি ও নিজস্ব সত্য খোঁজার ওপর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব দিচ্ছে। সুস্থ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানুষকে নিজস্ব বিকাশের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত রাখে। কিন্তু যখন এই প্রবণতা চরমে পৌঁছে যায়, তখন তা রূপ নেয় হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমে — যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ, আরাম আর স্বপ্নের জায়গা পায় সমাজ ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব।

হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম কী

হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম মূলত সেই মানসিকতা যেখানে সমাজ বা অন্যদের প্রয়োজনকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়। ব্যক্তিগত সাফল্য ও সন্তুষ্টিই হয়ে ওঠে চূড়ান্ত লক্ষ্য। এর প্রভাবে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি হওয়া এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে বহুজাতিক সংস্কৃতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দ্রুত আধুনিকায়নের মধ্যে এই প্রবণতা কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মানুষ তাদের মতামত জানিয়েছেন।

High costs a barrier to mental health support in UAE, report finds | The  National

নিজেকে আগে রাখার মানসিকতা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ‘youvegotthis.ae’ এর ক্যাট বলেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এক ধরনের চরম রূপ। আজ মানুষ নিজেদের শক্তি রক্ষা, সীমা নির্ধারণ এবং স্বপ্নপূরণে এতটাই মনোযোগী যে সম্পর্কের জটিলতা বা পারস্পরিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

তিনি জানান, বন্ধুত্বেও এখন দেখা যাচ্ছে “কুইয়েট কুইটিং” — কোনো বড় দ্বন্দ্ব ছাড়াই দীর্ঘদিনের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ, পরিবারের ভাঙন ও শহুরে জীবনের একাকিত্ব এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

ভারসাম্যের প্রয়োজন

দুবাইয়ের হেরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিওনা রবসন বলেন, সবকিছুই পরিস্থিতি নির্ভর। কর্মক্ষেত্রে টিমওয়ার্ক জরুরি হলেও অনেকেই কেবল ব্যক্তিগত লক্ষ্য নিয়েই ব্যস্ত। তাই শিক্ষা ও কর্মজীবনে দলগত কাজের মূল্যায়ন জরুরি।

তার মতে, ম্যানেজার ও নিয়োগকর্তাদের দায়িত্ব হলো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ক্ষতিকর হতে পারে তা চিহ্নিত করা এবং সমষ্টিগত দায়িত্বের নিয়ম পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা।

সামাজিক বন্ধন ভাঙনের ঝুঁকি

দুবাই-ভিত্তিক ব্যবসায়ী সিন্ধু বিজু মনে করেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম মানুষের বিবর্তনের শুরু থেকেই ছিল, তবে সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতামূলক যুগে এটি আরও বেড়েছে। এর ফলে সমাজে সমষ্টিগত মঙ্গল উপেক্ষিত হচ্ছে।

Individualistic Practices and Values Increasing Around the World –  Association for Psychological Science – APS

তবে তিনি বলেন, সংকটকাল যেমন কোভিড-১৯ মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ আবারও একত্রিত হয়। অর্থাৎ সঠিকভাবে মোকাবিলা করলে এ প্রবণতা সামলানো সম্ভব।

আশার আলো

দুবাই-ভিত্তিক মার্কেটিং পেশাজীবী অর্ণব ঘোষ মনে করেন, হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজম শহুরে জীবনের অংশ, তবে পরিস্থিতি সবসময় অন্ধকার নয়। তিনি বলেন, মানুষের জীবনে এখনও বন্ধু ও সমাজের জায়গা আছে, যদিও তা ব্যক্তিগত সুবিধার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

অর্ণব মনে করেন, অনেক ঐতিহাসিক উদ্ভাবন — যেমন স্টিভ জবসের অ্যাপল গড়ে তোলা — হাইপার-ইনডিভিজুয়ালিজমের ফল। ব্যক্তিগত দৃষ্টি ও দৃঢ়তা অনেক সময় সমাজকেই এগিয়ে নেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, যা অনেককে আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সমষ্টিগত দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াই টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

অবশেষে, অগ্রগতি সম্ভব তখনই যখন ব্যক্তি বিকাশ ও সামাজিক সংহতি একসঙ্গে এগোয়।