দুর্নীতির অভিযোগে নতুন বিতর্ক
ফিলিপাইনের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য হাজারো প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও সেগুলো ঘিরে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রেরই মধ্যে এসব প্রকল্পের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
স্থানীয়দের হতাশা
মানিলার কাছে আঙ্গাত নদীর তীরে বসবাসকারী মারিতেস আলভারো বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অপেক্ষায় ছিলেন। ২০১৯ সালে কাজ শুরুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা শুরু হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। তিনি বলেন, প্রকল্প শুরুর খবর শুনে তারা খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ বিলম্ব স্থানীয়দের ক্ষোভ বাড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব
প্রতিবছর গড়ে ২০টি টাইফুন ফিলিপাইনে আঘাত হানে। এ বছরের জুলাই-আগস্টে তিনটি টাইফুন এবং মৌসুমি বৃষ্টিতে প্রায় ১৬.৫১ বিলিয়ন পেসোর অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ বিলিয়ন পেসো। এর ফলে এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে।
দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাস
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ফিলিপাইন অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। দেশটির অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১১৪তম। অনেকের মতে, মার্কোস পরিবারও দীর্ঘদিন ধরে এই দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট শ্রেণির অংশ।
প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ
২০১৬ সালে রদ্রিগো দুতের্তে সরকারের আমলে বড় পরিসরে অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পও ছিল। মার্কোস সরকার জানিয়েছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৯,৮৫৬টি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫,৭০০টি নির্মাণাধীন। ইতিমধ্যে ৫৪৫ বিলিয়ন পেসো ব্যয় হয়েছে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো আত্মসাতের অভিযোগ এসেছে।
রাজনৈতিক ও জনঅসন্তোষ
মার্কোস জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে ২৫০.৮ বিলিয়ন পেসোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতের বরাদ্দ বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি জনরোষ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কুয়েজন সিটিতে প্রায় ২,৫০০ মানুষ দুর্নীতিবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন আরও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। ব্যবসায়ী মহলও দুর্নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে, একে “অর্থনৈতিক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড” আখ্যা দিয়েছে।
রাজনীতিবিদদের জড়িত থাকার অভিযোগ
সেনেটে শুনানিতে প্রকাশিত হয়েছে যে একাধিক নির্মাণ কোম্পানি একই প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে তারা এই সুবিধা পাচ্ছিল।
কংগ্রেসে শোনা যায়, কয়েকজন সংসদ সদস্য ও সেনেটরের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতের্তের ছেলে পাওলো দুতের্তের নামও এসেছে, যিনি ৫১ বিলিয়ন পেসো কিকব্যাক নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রভাব
মার্কোস ও দুতের্তে পরিবার ২০২২ সালের নির্বাচনে একসঙ্গে কাজ করলেও বর্তমানে তাদের সম্পর্ক খারাপ। এ বছরের শুরুতে ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতের্তের বিরুদ্ধে অভিশংসনের চেষ্টা হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারি বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে। লা স্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি লরেন্স বোরজা সতর্ক করে বলেছেন, যদি এ সমস্যার সমাধান না হয় তবে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে, আর যারা থাকবে তারা সম্ভবত দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা নেওয়ার প্রবণতাই বাড়াবে।
ফিলিপাইনের জনগণ ইতিমধ্যে বন্যা ও টাইফুনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। এর মধ্যেই দুর্নীতি-ঘেরা প্রকল্পগুলো মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। জনমনে তৈরি হয়েছে ধারণা—এই অর্থ আত্মসাত না হলে প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হয়ে জনগণের উপকারে আসত।