স্পেনের ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু
১৩ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটার আগে ফোন পান স্পেনের গালিসিয়ার ছোট্ট শহর লারুকোর মেয়র প্যাট্রিসিয়া লামেলা। তাঁকে প্রতিবেশী জানালেন, নিকটবর্তী বনে আগুন লেগেছে। টানা দুই সপ্তাহ ধরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা, ভিজে বসন্ত শেষে শুকিয়ে যাওয়া আগাছা, আর বন পরিষ্কার-পরিচর্যার অভাব—সব মিলিয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড সময়ের ব্যাপার ছিল।
প্রথম কয়েক ঘণ্টা আগুন নেভাতে লড়েছিলেন কেবল গ্রামবাসী আর তাঁদের একমাত্র ফায়ার ট্রাক। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে গালিসিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাবানলে পরিণত হয়, যেখানে ৩০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা পুড়ে যায়।
ইউরোপজুড়ে আগুনের থাবা
স্পেন-পর্তুগালেই নয়, ইউরোপজুড়ে একই দৃশ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ বছর ১,৯০০-র বেশি দাবানল হয়েছে। ইউরোপীয় ফায়ার ইনফরমেশন সিস্টেমের হিসাব অনুযায়ী, মোট ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা প্রায় ৯,৮৬০ বর্গকিলোমিটার—যা সাইপ্রাসের আকারের চেয়েও বড়।
দ্রুত উষ্ণ হওয়া মহাদেশ হিসেবে ইউরোপ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা স্পষ্টভাবে পাচ্ছে। তাপদাহ আর খরার কারণে আগুন আরও তীব্র হচ্ছে। তবে সমস্যার মধ্যে আছে সমন্বয়ের অভাব, জমির খণ্ড খণ্ড মালিকানা আর সীমিত সম্পদ। ফলে অনেক জায়গায় ছোট আগুনও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে
দমকল বাহিনী ও প্রশাসনের দুর্বলতা
লামেলার কথায়, আগুনের আচরণ এ বছর সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আগুন পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে এসে ভয়াবহ গতিতে গ্রাম আক্রমণ করে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা দিন-রাত পরিশ্রম করেন, একজন দমকলকর্মী টানা ১৭ ঘণ্টা কাজ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
প্রথমবারের মতো স্পেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিভিল প্রোটেকশন মেকানিজম সক্রিয় করতে হয়, যাতে অন্য সদস্য দেশ থেকে সহায়তা পাওয়া যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও প্রশাসনিক জটিলতায় তৎপরতা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়।
রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আমলাতান্ত্রিক জট
পাশের শহর আ রুয়াতে একটি বর্জ্য ফেলার স্থানে আগুন লাগে। দুই সপ্তাহ ধরে তা জ্বলতে থাকে কেবল স্থানীয় আর আঞ্চলিক রাজনীতিকদের দ্বন্দ্বে কে আগুন নেভাবে তা ঠিক না হওয়ায়।
পর্তুগালেও একই ছবি—প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টেনেগ্রোকে দোষারোপ করা হয় দেরিতে ইইউ-র সাহায্য চাওয়ার জন্য। গ্রীষ্মের ছুটির কারণে মন্ত্রিসভার বৈঠক দেরিতে হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
ব্যক্তিগত জমির খণ্ড খণ্ড মালিকানা
স্পেন-পর্তুগালের উত্তরাঞ্চলে বনাঞ্চলের বড় অংশ ব্যক্তিগত মালিকানায়, ছড়ানো ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত। অনেক মালিক অনুপস্থিত কিংবা জমির অস্তিত্বও জানেন না। আইনে আগাছা পরিষ্কার করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব।
আ রুয়াতে আগুনে ব্যক্তিগত বন আর পতিত কৃষিজমি ছাই হয়ে গেলেও বহু পুরনো গদেলো আঙুরক্ষেত রক্ষা পেয়েছে। স্থানীয়দের মতে, এ ধরনের আঙুরক্ষেত আগুন ঠেকাতে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করেছে। একই চিত্র দেখা গেছে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলেও, যেখানে আঙুরক্ষেত না থাকা জায়গায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন দাবানলের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়াচ্ছে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন, একসময় শত বছরে একবার ঘটত এমন দাবানল এখন ২০ বছরে একবার হচ্ছে।
স্পেন-পর্তুগালের দাবানল ৪০ গুণ বেশি সম্ভাব্য হয়ে উঠেছে, আগুনের তীব্রতাও প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, দাবানল থেকে নির্গত কার্বনও ইউরোপের বায়ু দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গ্রীসের প্রস্তুতি
গ্রীস ২ বিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে নতুন বিমান, ড্রোন, গাড়ি আর নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে স্পেন-পর্তুগালের মতো একইসঙ্গে বহু ভয়াবহ দাবানল এড়ানো গেছে। তবু অন্তত ৩২ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরাতে হয়েছে, ১৩ দমকলকর্মী আহত হয়েছেন এবং দ্বীপ কাইথেরার অর্ধেক পুড়ে গেছে।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি
গ্রীসের এক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন, এথেন্স অঞ্চলে এক দশকেরও কম সময়ে বনভূমির ৪০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। ইউরোপের দাবানলের এই রেকর্ড মৌসুম প্রমাণ করছে—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, এমনকি প্রস্তুত দেশগুলোর জন্যও।
তৃতীয় বছরের মতো টানা গ্রীষ্মে ইউরোপের বহু দেশ অপ্রত্যাশিতভাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মুখে পড়ছে।