গোপন অভিযানের সূচনা
২০১৯ সালের শীতের এক অন্ধকার রাতে মার্কিন নেভি সিলসের একটি দল গোপনে উত্তর কোরিয়ার এক নির্জন উপকূলে পৌঁছে যায়। তাদের দায়িত্ব ছিল একটি বিশেষ ইলেকট্রনিক যন্ত্র স্থাপন করা, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের যোগাযোগ আটকাতে পারবে। সে সময় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কিম জং উনের পারমাণবিক আলোচনা চলছিল।
অভিযানটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে এটি অনুমোদনের জন্য প্রেসিডেন্টের সরাসরি সম্মতি প্রয়োজন হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিল টিম ৬-এর রেড স্কোয়াড্রনকে, যারা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
হঠাৎ বিপত্তি
সিল সদস্যরা যখন ভেবেছিল তারা নির্জন উপকূলে নেমেছে, তখনই অন্ধকার থেকে একটি উত্তর কোরীয় নৌকা ভেসে ওঠে। টর্চলাইটের আলো পানির উপর ঘুরে বেড়ায়। আতঙ্কে সিলরা গুলি চালায়। মুহূর্তের মধ্যে নৌকায় থাকা সবাই নিহত হয়। পরে জানা যায়, তারা ছিল বেসামরিক মানুষ, সম্ভবত ঝিনুক সংগ্রহকারী জেলে।
অভিযানের মূল কাজ — ইলেকট্রনিক ডিভাইস বসানো — অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সিলরা তৎক্ষণাৎ সমুদ্রে ফিরে যায়।
গোপনীয়তা ও আইন ভঙ্গের প্রশ্ন
এই অভিযান যুক্তরাষ্ট্র বা উত্তর কোরিয়া কখনো প্রকাশ করেনি। বিষয়টি গোপন রাখা হয়, এমনকি কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিকেও জানানো হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে আইন লঙ্ঘন হয়েছে।
অভিযানের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় দুই ডজন সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক সামরিক সদস্য এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার থেকে। তারা জানান, বিশেষ অভিযান ব্যর্থতার ঘটনা সাধারণত গোপন রাখা হয়, যাতে কেবল সফল অভিযানের ভাবমূর্তি জনগণের সামনে আসে।
কৌশলগত অন্ধকার
উত্তর কোরিয়ার মতো বন্ধ রাষ্ট্রে মার্কিন গোয়েন্দাদের মানবসূত্র বা যোগাযোগ আটকানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। ট্রাম্প প্রশাসন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে কিম জং উনের যোগাযোগ ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু এ জন্য বিপজ্জনকভাবে মার্কিন সেনাদের উত্তর কোরিয়ার মাটিতে প্রবেশ করতে হয়।
আগেও ২০০৫ সালে একবার সিল সদস্যরা ছোট সাবমেরিন ব্যবহার করে উত্তর কোরিয়ায় গোপনে প্রবেশ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ২০১৮ সালে এই অভিযানের পরিকল্পনা হয়।
ব্যর্থতার কারণ
অভিযানের সময় কয়েকটি ছোট ভুল বড় বিপর্যয় ডেকে আনে।
- দ্বিতীয় মিনি-সাব নির্ধারিত স্থানে না থেমে ঘুরে দাঁড়ায়, ফলে অবস্থান এলোমেলো হয়ে যায়।
- সিল সদস্যরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাথা তুলে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে, তখন নৌকাটি তাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
- সাবমেরিনের মোটরের শব্দ হয়তো উত্তর কোরীয় নৌকাটিকে সজাগ করে তোলে।
ফলে নৌকাটি তাদের দিকে এগিয়ে এসে আলো ফেলে পরিস্থিতি স্পষ্ট করে। সিল সদস্যরা বুঝতে না পেরে গুলি চালায় এবং নিরস্ত্র জেলেদের হত্যা করে।
ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া
অভিযান শেষে মার্কিন সাবমেরিন দ্রুত ঝুঁকি নিয়ে তীরে আসে এবং সিলদের উদ্ধার করে। সবাই নিরাপদে ফিরে যায়, তবে নিরীহ বেসামরিকরা নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট তখন উত্তর কোরীয় সেনাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়।
তবুও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামে ট্রাম্প-কিম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তবে কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়। এর পরপরই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা পুনরায় শুরু করে।
বিতর্ক ও গোপন তদন্ত
অভিযানটি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণভাবে কিছু তদন্ত করে এবং জানায় যে সিলদের বেসামরিক হত্যাকাণ্ড নিয়মভঙ্গ নয়, বরং পরিস্থিতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বিষয়টি কংগ্রেসকে জানানো হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল গুরুতর আইন লঙ্ঘন।
পরে বাইডেন প্রশাসন এ নিয়ে নতুন তদন্ত শুরু করে এবং ২০২১ সালে কংগ্রেসের কিছু সদস্যকে গোপনে অবহিত করে। তবে ফলাফল এখনো গোপন রাখা হয়েছে।
সিলদের মিশ্র রেকর্ড
সিল টিম ৬ বহু সফল অভিযান চালালেও, অনেক ব্যর্থ মিশনের ইতিহাসও রয়েছে। ১৯৮৩ সালে গ্রেনাডায় তাদের প্রথম অভিযান ব্যর্থ হয়, চারজন সদস্য ডুবে মারা যান। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়ায়ও কিছু অভিযান বিপর্যয়ে শেষ হয়।
ওবামা প্রশাসন সেসব ঝুঁকির কারণে বিশেষ অভিযানে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে আবারও সীমাবদ্ধতা শিথিল করেন। তার প্রথম বছরেই ইয়েমেনে এক অভিযানে ৩০ জন গ্রামবাসী এবং এক মার্কিন সিল নিহত হয়।
২০১৯ সালের ব্যর্থ উত্তর কোরিয়া অভিযান আবারও দেখিয়েছে, বিশেষ অভিযানের সাফল্য যতটা প্রচার পায়, ব্যর্থতাগুলো ততটাই গোপন রাখা হয়। এই ব্যর্থতা শুধু নিরীহ প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কেও অনিশ্চয়তার নতুন অধ্যায় যোগ করেছে।