অলি সরকারের পতনের পর নতুন নেতৃত্বের খোঁজ
নেপালে দুর্নীতিবিরোধী সহিংস বিক্ষোভে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেছেন। এর পরবর্তী ধাপে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে কাকে বসানো হবে—সে প্রশ্নে সামনে এসেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নাম।
অনলাইন ভোটে কার্কির এগিয়ে থাকা
ডিসকর্ড অ্যাপে অনলাইনে অনুষ্ঠিত ভোটে প্রাক্তন বিচারপতি কার্কি সবচেয়ে বেশি সমর্থন পান। তিনি পরাজিত করেন ইনফ্লুয়েন্সার রাষ্ট্র বিমোচন তিমলসিনা, তরুণ রাজনীতিক সাগর ঢাকাল, ধরান শহরের মেয়র হার্কা সামপাং এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গ্রামীণ উন্নয়ন খ্যাত সমাজকর্মী মহাবীর পুনকে।
৭৩ বছর বয়সী কার্কি ২০১৬ সালে নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান ব্যাপকভাবে পরিচিত।
তরুণদের প্রত্যাশা ও বিভক্তি
কাঠমান্ডুর এক তরুণী একতা অধিকারী বলেন, কার্কি যদি নেতৃত্ব দেন তবে তিনি নারী অধিকার ও মাওবাদী বিদ্রোহ চলাকালীন যৌন সহিংসতার মামলাগুলোতেও মনোযোগ দেবেন বলে আশা। তাঁর মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি ভিত্তি তৈরি করা।
তবে সবাই এই প্রস্তাবে একমত নন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কার্কি অলি সরকারের সময় নিযুক্ত হওয়ায় তিনি কতটা নিরপেক্ষ থাকবেন। এ কারণে তারা র্যাপার থেকে কাঠমান্ডুর মেয়র হওয়া বালেন শাহকে নেতৃত্বে দেখতে চান। কিন্তু শাহ নিজেই সামাজিক মাধ্যমে কার্কির নেতৃত্বকে সমর্থন জানিয়েছেন।
ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
একজন অংশগ্রহণকারী জানান, ডিসকর্ড গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৪০ হাজার হলেও ভোট শেষ হয় মাত্র ৭,৭১৩ জন ভোট দেওয়ার পর, যেখানে কার্কি ৫০ শতাংশ ভোট পান। ফলে ভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি বলেন, কার্কিকে অবশ্যই প্রকাশ্যে শপথ নিতে হবে যাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
সংবিধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাবনা
স্বাধীন গবেষক ভাস্কর গৌতম মনে করেন, সংবিধানের জরুরি ধারা প্রয়োগ করে কার্কিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা যেতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, সরকারের মূল দায়িত্ব হবে সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনআস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অবাধ নির্বাচন আয়োজন। অন্যথায় গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক কর্তৃত্ব জারি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সহিংসতা ও সামাজিক ক্ষতি
সরকারি হিসেবে সোমবারের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত হয়, মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০-এ। আহত হয়েছেন ১,৩০০ জনেরও বেশি। সরকারি-বেসরকারি ভবন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তরুণরা দাবি করেছে, এসব সহিংসতা তাদের আন্দোলনের অংশ নয়; বরং রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত গোষ্ঠী এ কাজ করেছে।
জেন জেডের দাবি ও সংকট
তরুণদের উদ্যোগে ‘ন্যায়সঙ্গত নেপাল’-এর একটি ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, নতুন নির্বাচন ও সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। প্রতিনিধি সুধন গুরুং জানান, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পক্ষে অনেক তরুণ, কারণ তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আস্থা হারিয়েছে।
তবে গৌতম বলেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং জেন জেড আন্দোলনকে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তাঁর মতে, তাদের রাজনৈতিক কল্পনা অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেপালের প্রতিবেশী ভারত ও চীনের উচিত গণতন্ত্র ও বেসামরিক শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে সহায়তা করা। কেন্দ্র ফর সোশ্যাল ইনক্লুশন অ্যান্ড ফেডারেলিজমের চেয়ারম্যান বিজয় কান্ত কর্ণা বলেন, সব গণতান্ত্রিক সংলাপ রাষ্ট্রপতির বাসভবনে হওয়া উচিত, সেনা সদর দপ্তরে নয়।
তিনি সতর্ক করে বলেন, দেশে বড় ধরনের ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘায়িত হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রতিশ্রুতিগুলো সংকটে পড়বে।
নেপালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এই সময়ে সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পথে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। তবে তাঁকে ঘিরে বিতর্ক, তরুণদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে নেপালের সামনে চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত কঠিন।