নগর জন্তুদের উৎথান
বিশ্বের অনেক শহরেই বন্যপ্রাণীর ঝামেলা রয়েছে। বার্লিনে বুনো শূকর, বুয়েনোস আইরেসে ক্যাপিবারা আর ক্যামব্রিজে বুনো টার্কি মানুষের জন্য বিপদ। তবে ভারতের নগরীগুলো এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে। এখানে রাস্তার কুকুর, বেওয়ারিশ বিড়াল, গরু, নানান প্রজাতির বানর, সাপ, এমনকি কখনো কখনো চিতাবাঘও দেখা যায়। শহরগুলো যতই বড় হচ্ছে, মানুষ ও প্রাণীর সংঘর্ষও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দিল্লির কুকুর আতঙ্ক
দিল্লিতে এক মিলিয়ন রাস্তার কুকুর রয়েছে। গত বছর সেখানে ২৫,২১০টি কুকুর কামড়ের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। শুধু জানুয়ারি মাসেই প্রতিদিন ১০০-এর বেশি কামড়ের খবর পাওয়া গেছে। সরকার বলছে, গত বছর সারা ভারতে জলাতঙ্কে মারা গেছে ৫৪ জন, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সংখ্যা ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশ। বেশিরভাগ ভুক্তভোগী শিশু।
কিন্তু বিপদ শুধু কুকুরেই সীমাবদ্ধ নয়। গরু সম্পত্তি নষ্ট করে, ট্রাফিক আটকায় এবং দুর্ঘটনা ঘটায়। বানর খাবার এমনকি মোবাইলও চুরি করে, মানুষকে আক্রমণ করে। সাপ সাধারণত শান্ত থাকে, কিন্তু হুমকি পেলে কামড় দেয়। ভারতে সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদিকে মুম্বাইয়ের চিতা মাঝে মাঝে কুকুর আক্রমণ করে, গাড়ির নিচে সাপ মরে যায়, আর বিদ্যুতের তারে আটকে পাখি মরে যায়।
কেন শহরে এত প্রাণী?
শহরের দ্রুত সম্প্রসারণ বন্যপ্রাণীর আবাস দখল করেছে। যেমন বেঙ্গালুরুতে ২০০৮ সালে অর্ধেক জমি ছিল অবিকশিত, এখন ৮৮% জায়গায় ভবন ও রাস্তা। এতে অনেক প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু প্রাণী নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। স্থানীয় প্রাণী হাসপাতালের প্রধান নওয়াজ শেরিফ বলছেন, আগে শুধু শহরের প্রান্তে সাপের দেখা মিলত, এখন সর্বত্র ডিম ফোটার খবর পাওয়া যায়।
শহরের দুর্বল প্রশাসনও সমস্যা বাড়িয়েছে। ফেলে রাখা গাড়ি, নির্মাণকাজের ধ্বংসাবশেষ প্রাণীদের আশ্রয় দেয়। লিক হওয়া পাইপ ও বৃষ্টির গর্ত থেকে পানি পাওয়া যায়। অযত্নে ফেলা আবর্জনা খাবারের জোগান দেয়। যেখানে ময়লা পরিষ্কারই হয় না, সেখানে প্রাণী নিয়ন্ত্রণের আইন, যেমন কুকুরের নির্বীজকরণ, কার্যকর হবে কীভাবে?
সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব
ভারতের প্রাণী সমস্যা শুধু প্রশাসনিক নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিকও। কঠোর প্রাণী সুরক্ষা আইন মানুষের পক্ষে কুকুরকে তাড়ানো বা হত্যা করা অসম্ভব করেছে। ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও ভূমিকা রাখছে। হিন্দুধর্মে বানরকে হনুমানের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়, নাগপঞ্চমীতে সাপ পূজা হয়, আর গরুকে মা হিসেবে পূজা করা হয়।
সম্প্রতি মুম্বাইয়ে পায়রা খাওয়ানো বন্ধ করার সিদ্ধান্তে বিক্ষোভ হয়। কর্মকর্তারা জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যবস্থা নিলেও জৈন ধর্মাবলম্বীরা মানেননি। এমনকি একজন সন্ন্যাসী সশস্ত্র প্রতিরোধের হুমকি জানান। জৈনরা সংখ্যায় কম হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাই রাজনীতিকরা তাদের বিরোধিতা করতে সাহস পান না।
আদালতের নির্দেশ ও বাস্তবতা
গত মাসে সুপ্রিম কোর্ট কুকুরের আক্রমণে শিশুদের মৃত্যুর পর দিল্লি কর্তৃপক্ষকে আট সপ্তাহের মধ্যে সব কুকুরকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। প্রাণীপ্রেমীদের তীব্র আপত্তিতে পরে আদালত আদেশ পরিবর্তন করে। এখন বলা হয়েছে, কুকুর ধরার পর টিকা ও নির্বীজকরণের পর ছেড়ে দেওয়া যাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দিল্লির প্রশাসনের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এমনকি খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ করার নিয়মও কার্যকর করা কঠিন হবে।
সম্ভাব্য সমাধান
প্রশাসনকে বাড়তি তহবিল দেওয়া, প্রাণী প্রজনন নিয়ন্ত্রণের সুসংগঠিত কর্মসূচি চালু করা এবং সবচেয়ে জরুরি, নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কার করা শহরকে প্রাণীর জন্য কম অনুকূল করতে পারে। তবে শুধুমাত্র সরকারি নীতিতেই সমস্যার সমাধান হবে না। নাগরিকদেরও মনোভাব বদলাতে হবে। বিশেষজ্ঞ কিশোর রিঠে বলছেন, ভারতের প্রাণী সমস্যা আবেগ দিয়ে নয়, বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।