ভূমিকা
তাইওয়ান প্রথমবারের মতো কোনো দেশের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক ধরনের আক্রমণাত্মক বার্তাও বহন করছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা
গত সপ্তাহে তাইপে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি সীমিত করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকাণ্ড তাইওয়ানের জাতীয় ও জননিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই পদক্ষেপকে তাইওয়ান সরকারের নতুন কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে অর্থনীতি ও বাণিজ্য নীতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
একজন তাইওয়ানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে অন্যান্য অমিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
চিপ সরবরাহ ও বৈশ্বিক উদ্বেগ
অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়েন-টি সাং বলেন, “তাইওয়ান বৈশ্বিক চিপ সরবরাহ শৃঙ্খলে তার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বাধীন প্রতিরোধ কৌশল তৈরি করছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশও তাইওয়ানের কূটনৈতিক ছাড় ও কঠোর পদক্ষেপ দুই দিকই বিবেচনা করবে।
তাইওয়ান বড় ইউরোপীয় অর্থনীতি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রধান সহযোগীদের ওপর এমন বিধিনিষেধ আরোপ করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ছোট অংশীদার দেশগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ বৈশ্বিক চিপ সরবরাহের প্রতি উদ্বেগ বাড়াতে পারে।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডো তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীলতাকে ইউরোপের রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরতার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা এ ধরনের দুর্বল অবস্থায় থাকতে পারি না।”
যুক্তরাষ্ট্র ও বিকল্প উদ্যোগ
তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির (TSMC) সক্ষমতা নকল করা সহজ নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে—একদিকে TSMC-কে মার্কিন মাটিতে কারখানা গড়তে উৎসাহিত করছে, অন্যদিকে নিজস্ব চিপ শিল্পকে শক্তিশালী করছে।
গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর ও যন্ত্রপাতি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বড় সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন তার মিত্রদেরও একই নীতি অনুসরণ করতে চাপ দিচ্ছে। এতে অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরবরাহ শৃঙ্খলে আংশিক স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
চীনের প্রতি কড়া অবস্থান
চীনই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-টে আগ্রাসীভাবে বেইজিংয়ের চাপ মোকাবিলা করছেন। এ বছরের শুরুতে তাইওয়ান হুয়াওয়ে ও এসএমআইসির মতো বড় চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন অভিযোগ করেছেন, তাইওয়ানের পদক্ষেপ বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে অস্থিতিশীল করছে। একইসঙ্গে তিনি চিপ খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ইস্যু
তাইওয়ানের গবেষণা বিশ্লেষক ক্যাথি ফাং বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর এই নীতি এখনো “নোটিফিকেশন পর্যায়ে” আছে, ফলে আলোচনার সুযোগ খোলা রাখা হয়েছে।
মূল দ্বন্দ্ব ঘিরে আছে তাইওয়ানের কার্যত দূতাবাস নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেও এখনও একটি অফিস বজায় আছে। কিন্তু ২০২৩ সালে ব্রিকস সম্মেলনের পর দক্ষিণ আফ্রিকা তাইওয়ানকে রাজধানী থেকে জোহানেসবার্গে অফিস সরাতে চাপ বাড়ায়।
তাইওয়ানি কর্মকর্তারা জানান, চিপ নিষেধাজ্ঞা মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আলোচনা চালানোর কৌশল।
অর্থনৈতিক প্রভাব
দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি বিদেশি গাড়ি নির্মাতা কারখানার ওপর নির্ভরশীল। সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ সংকটে তাদের প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও তাইওয়ানের কর্মকর্তারা বলেন, এসব কোম্পানি সাধারণত বিশ্বব্যাপী সরবরাহকারীর মাধ্যমে চিপ সংগ্রহ করে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছর তাইওয়ান দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করেছিল। অর্থাৎ, নিষেধাজ্ঞার প্রতীকী দিকই বেশি।
কূটনৈতিক বাস্তবতা ও চীনের চাপ
চীনের প্রভাবে তাইওয়ানের মাত্র ১২টি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক মিত্র বাকি আছে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কগুলোও এখন চীনের নজরদারির মধ্যে।
সাম্প্রতিককালে বেইজিংয়ের হস্তক্ষেপে কাজাখস্তানে একটি তাইওয়ানি শিল্প প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। আবার চেক প্রজাতন্ত্রে একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধনে চীনের পতাকা হাতে বিক্ষোভ দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক সংকট গোষ্ঠীর বিশ্লেষক উইলিয়াম ইয়াং মনে করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি তাইওয়ানের প্রতিক্রিয়া কেবল আত্মরক্ষামূলক। তবে এটি গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে তাইওয়ানের সঙ্গে সরবরাহ শৃঙ্খল সহযোগিতা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে।
তাইওয়ানের এই পদক্ষেপ প্রতীকী হলেও বার্তাটি স্পষ্ট—চিপ শিল্প শুধু অর্থনীতির হাতিয়ার নয়, এটি কূটনৈতিক শক্তিরও একটি অংশ। ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও কৌশলগত সমীকরণে তাইওয়ানের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।