রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: প্রথাগত দলের বিপরীতে এক নতুন উত্থান
২০২৫ সালের গ্রীষ্মে জাপানের শাসক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও তাদের জোটসঙ্গী সংসদের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এই অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল নতুন এক শক্তির উত্থান—সানসেইতো নামে একটি অতিদক্ষিণপন্থী দল, যা কোভিড-১৯ মহামারির সময় একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে শুরু হয়েছিল।
দলের মূল স্লোগান “জাপান প্রথম”। তারা কর হ্রাস, কৃষকদের সুরক্ষা, টিকার বিষয়ে সন্দেহ, এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও অভিবাসনে সীমাবদ্ধতা আরোপের মতো ইস্যুগুলিকে সামনে এনেছে।
নেতৃত্ব পরিবর্তন ও শাসক দলের সংকট
যদিও এলডিপির হাতে এখনো সর্বাধিক আসন রয়েছে, তবুও তাদের এই পরাজয়ের ধাক্কায় প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা পদত্যাগ করেন। শনিবার নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা রয়েছে, যিনি ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি দক্ষিণপন্থী ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কাজ করবেন।
সানসেইতো: “নীরব আগ্রাসন” ও বিতর্কিত বক্তব্য
দলটির নেতা সোহেই কামিয়া প্রকাশ্যে “বিদেশিদের নীরব আগ্রাসন” নিয়ে সতর্ক করেন। এক সভায় তিনি জাতিগত কোরীয়দের নিয়ে অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করে পরে ক্ষমা চান।
২০২২ সালে দলের প্রকাশিত এক বইয়ে কোভিড-১৯ আতঙ্ককে “আন্তর্জাতিক ইহুদি আর্থিক পুঁজির ষড়যন্ত্র” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। পরে দলটি বইটির ভাষা সংশোধনের দাবি জানায় এবং ইহুদিবিদ্বেষ অস্বীকার করে।
মধ্যবয়সী ভোটারদের ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতা
কামিয়ার মতে, দলের প্রধান সমর্থকরা ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষ—যারা শেয়ারবাজার ও করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধির পরও বাস্তবে আর্থিক চাপে ভুগছেন।
তিনি বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি কেবল শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা বাড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষের আয় নয়।” তাই দলটি ন্যায্য আয়বণ্টন ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছে।
সানসেইতো-সমর্থকদের সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তারা বাস্তব মজুরি স্থবিরতা ও এলডিপি থেকে বিমুখতার কারণে ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ বিদেশির সংখ্যা বৃদ্ধিকেও উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখেন।
করের বোঝা ও নাগরিক ক্ষোভ
সাইতামার ৫৬ বছর বয়সী নার্স মিয়েকো কুদো সানসেইতোতে যোগ দেন দলের ৩৫ শতাংশ কর সীমা নির্ধারণের প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে। বর্তমানে শ্রমিকদের করের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ, এবং বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সেবায় ব্যয় বাড়ায় সেটি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা।
তিনি বলেন, “বেতন স্লিপে চোখ রাখলেই দেখি, কেন এত সামাজিক বিমা দিতে হয়? কর দিচ্ছি, কিন্তু বাস্তবে উন্নতি কোথায়?”
সেইকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাসাকি ইতো মনে করেন, জাপানের রাজনীতিতে মধ্যবিত্তদের কথা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়, আর সানসেইতো সেই শূন্যতা পূরণ করছে।
সামাজিক মাধ্যমে বিদেশি-বিরোধী বক্তব্য
অনলাইনে অনেক পোস্ট দাবি করছে, বিদেশি শিক্ষার্থীরা সরকারি অনুদান পাচ্ছেন, অথচ জাপানি শিক্ষার্থীদের ঋণ শোধ করতে বছর লেগে যায়। বাস্তবে সরকারি সহায়তার অধিকাংশ সুবিধাভোগীই জাপানি, তবে এই তথ্য বিভ্রান্তি দূর করতে পারছে না।
ফুকুওকার ৩২ বছর বয়সী নগর নকশাবিদ আকানে ইকেদা বলেন, “আমি দেখি, বিদেশি পুঁজি গ্রামাঞ্চলে বিনিয়োগ করছে, কিন্তু স্থানীয় উন্নয়নে নয়। এসব নীতিতে শুরুর দিক থেকেই অব্যবস্থাপনা আছে।”
সরকারের নতুন কড়াকড়ি
বিদেশিদের জন্য ব্যবসা শুরুর মূলধনের সীমা ৫০ লাখ ইয়েন থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি ইয়েন করা হচ্ছে। পর্যটকদের অস্থায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ হবে এবং বিদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিতেও সীমাবদ্ধতা আসছে।
“বিদেশি-বিরোধী নয়, মানের প্রশ্ন” — সানসেইতো সমর্থকদের বক্তব্য
৩৯ বছর বয়সী উৎপাদন খাতের কর্মী এইসুকে কোবায়াশি বলেন, “বিদেশিরা অনেক বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করছে, সেটি প্রশংসনীয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘মানহীন বিদেশি’ সংখ্যা বেড়েছে, যা সমস্যা সৃষ্টি করছে।”
তবে এই বিদেশিরাই জাপানের বয়স্ক সমাজে শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। জাপান ব্যাংকের গভর্নর কাজুও উএদা জানিয়েছেন, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নতুন শ্রমশক্তি বৃদ্ধির অর্ধেকেরও বেশি এসেছে বিদেশিদের কাছ থেকে, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ।
অর্থনীতি স্থবির, ভোটারদের আস্থা হারাচ্ছে এলডিপি
কোবায়াশি বলেন, “জাপানের অর্থনীতি ৩০ বছর ধরে ভুগছে, আর এই সময়ের বেশিরভাগ জুড়ে এলডিপিই ক্ষমতায়।”
অধ্যাপক ইতো মনে করেন, ছোট দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি মানে জনগণ বড় পরিবর্তন আশা করছে। “এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কেমন সমাজ চাই — বড় সরকার, না ছোট?”
তরুণদের আকর্ষণ: নতুন রঙ ও সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব
ধূসর স্যুট পরা বৃদ্ধ রাজনীতিবিদদের ভিড়ে সানসেইতো এসেছে তরুণ নেতৃত্ব, উজ্জ্বল কমলা প্রচারণা ও সামাজিক মাধ্যমের শক্তি নিয়ে।
তোকিওর ৫৩ বছর বয়সী ব্যবসায়ী কোইচি ইনোউয়ে বলেন, “আমি সানসেইতোকে ভোট দিয়েছি, কিন্তু মনে হয় না তারা দেশ পাল্টে দেবে। শেষ পর্যন্ত এলডিপিই একমাত্র দল, যাদের হাতে শাসনের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব রয়েছে।”
জাপানের অতিদক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান একদিকে জনগণের অর্থনৈতিক অসন্তোষ, অন্যদিকে বিদেশি উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কার প্রতিফলন। সানসেইতো এই অসন্তোষের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে — যদিও তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রভাব এখনো অনিশ্চিত।