পরীক্ষায় বিপজ্জনক রাসায়নিক শনাক্ত
মধ্যপ্রদেশে ১১ শিশুর মৃত্যুর পর কাশির সিরাপের নমুনায় বিপজ্জনক রাসায়নিক ডাইইথিলিন গ্লাইকল (DEG) শনাক্ত হয়েছে। তামিলনাড়ুর কানচিপুরম জেলার একটি ওষুধ তৈরির কারখানায় উৎপাদিত ‘কোলডরিফ’ সিরাপে এই রাসায়নিকের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে প্রায় ৪৮ গুণ বেশি ছিল। বিশেষজ্ঞরা একে “চরম বিপজ্জনক” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তামিলনাড়ুর খাদ্য নিরাপত্তা ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগের একটি দল গত সপ্তাহে কারখানাটি পরিদর্শন করে নমুনা সংগ্রহ করে। শনিবার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। কর্মকর্তারা জানান, সিরাপে ভেজাল ধরা পড়েছে এবং কোম্পানিকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। ব্যাখ্যা না, দেওয়া পর্যন্ত উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তামিলনাড়ু, রাজস্থান, কেরালা ও মধ্যপ্রদেশে নিষেধাজ্ঞা
তামিলনাড়ু সরকার ১ অক্টোবর থেকে ‘কোলডরিফ’ সিরাপ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে এবং বাজার থেকে সব মজুদ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই সিরাপ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও পুদুচেরি তেও সরবরাহ করা হয়েছিল। এর পরপরই রাজস্থান, কেরালা ও মধ্যপ্রদেশ পৃথকভাবে এই ওষুধের বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেয়।
ডাইইথিলিন গ্লাইকল একটি বর্ণহীন, ঘন তরল যা সাধারণত শিল্পকারখানায় ব্রেক ফ্লুইড বা অ্যান্টিফ্রিজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে কম খরচে বিকল্প দ্রাবক হিসেবে এটি অবৈধভাবে ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। এই উপাদান শরীরে প্রবেশ করলে তীব্র পেটব্যথা, বমি, কিডনি অকেজো হয়ে পড়া এবং মারাত্মক ক্ষেত্রে ৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটতে পারে।
মধ্যপ্রদেশে মৃত্যুর পর রাজ্যজুড়ে কঠোর পদক্ষেপ
শনিবার সকালে তামিলনাড়ুর তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব রাজ্যজুড়ে ‘কোলডরিফ’ সিরাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “এই ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। সিরাপসহ কোম্পানির অন্যান্য পণ্যও বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
রাজ্য সরকার ঘটনাটি জানার পর তামিলনাড়ু সরকারকে তদন্তের অনুরোধ করে এবং রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়। যাদব আরও জানান, রাজ্য পর্যায়ে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। একই দিন রাজ্যে আরও দুই শিশুর মৃত্যুর খবর আসে।
সরকার ঘোষণা করেছে, মৃতদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং চিকিৎসাধীন শিশুদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে রাজ্য সরকার।
চিন্ডওয়ারা জেলার পুলিশ সুপার অজয় পান্ডে জানান, কানচিপুরম কারখানার মালিক, স্থানীয় চিকিৎসক প্রবীণ সোনি এবং আরও এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত হত্যাসহ ওষুধ আইন অনুযায়ী মামলা হয়েছে।
কেরালায় সতর্কতা ও বিক্রি স্থগিত
কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভীণা জর্জ জানান, অন্য রাজ্যের রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক বিভাগও ‘কোলডরিফ’ বিক্রি স্থগিত করেছে। যদিও তদন্তে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাচটি কেরালায় বিক্রি হয়নি, তবুও নিরাপত্তার স্বার্থে আটটি পরিবেশককে বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব ফার্মেসিকেও বিক্রি স্থগিতের নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।
এই ঘোষণা আসে একদিন পর যখন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল যে ল্যাব পরীক্ষায় ‘কোলডরিফ’ সিরাপে DEG বা ইথিলিন গ্লাইকল পাওয়া যায়নি। কিন্তু নতুন পরীক্ষায় ফলাফল ভিন্ন এসেছে।
শিশুদের বয়স ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত ত্রুটি
২০২৩ সালে ভারতের স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছিল যে ‘কোলডরিফ’ চার বছরের নিচের শিশুদের দেওয়া বিপজ্জনক। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে এই বয়সের শিশুদেরই ওষুধটি দেওয়া হয়েছিল। নয়জন মৃত শিশুর মধ্যে সাতজনের বয়স ছিল চার বছরের নিচে, বাকিরা পাঁচ বছর বয়সী, অর্থাৎ সরকারি নির্দেশিত সীমার কাছাকাছি বা নিচে।
সন্দেহের তালিকায় আরেকটি সিরাপ
মধ্যপ্রদেশের ড্রাগ কন্ট্রোলার ডি.কে. মৌর্য জানান, মোট ১৯টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি রাজ্যের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা চলছে। চারটির রিপোর্ট এসেছে, বাকি এখনও পরীক্ষাাধীন। আরেকটি সন্দেহভাজন সিরাপ ‘নেক্সা ডি.এস.’ (হিমাচল প্রদেশে উৎপাদিত) পরীক্ষাধীন রয়েছে।
তিনি আরও জানান, ‘কোলডরিফ’ মূলত চিন্ডওয়ারা অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়েছিল, অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তবুও সব জেলায় ওষুধ পরিদর্শকদের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজস্থানে ছয় বছরের শিশুর মৃত্যু
রাজস্থানের চুরু জেলায় শনিবার ছয় বছর বয়সী আনাস নামে এক শিশু কাশির সিরাপ খাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করে। জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মনোজ শর্মা জানান, শিশুটি বুধবার রাতে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তার বাবা-মা জানান, তারা কয়েক দিন আগে তাকে ‘ডেক্সট্রোমেথরফান এইচবিআর’ সিরাপ দিয়েছিলেন।
অবস্থার অবনতি হলে তাকে জয়পুরের জে.কে. লন হাসপাতালে পাঠানো হয়, যেখানে শনিবার তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শিশুটির অবস্থা ক্রমশ অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাকে স্থানান্তর করেন, কিন্তু প্রাণে বাঁচানো যায়নি।
কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহির দাবি
দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একই ধরনের মৃত্যুর ঘটনায় এখন ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরীক্ষা ও কঠোর উৎপাদন নিয়ম না মানলে এমন দুর্ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।
সরকারি ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কঠোর নীতিমালা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।