এ বছর কোয়াড সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি আয়োজিত হওয়ার কথা ছিল দিল্লিতে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যস্ততা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার কারণে প্রস্তুতি কার্যত থমকে গেছে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত সহযোগিতার অন্যতম প্রধান এই ফোরাম বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
কোয়াডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
কোয়াড বা Quadrilateral Security Dialogue (QSD) প্রথম প্রস্তাব করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০০৭ সালে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সমর্থনে এটি চালু হলেও প্রথমদিকে তা খুব বেশি সক্রিয় হয়নি। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়া এই জোট থেকে সরে গেলে কার্যত কোয়াডের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়।
তবে চীনের দ্রুত উত্থান ও দক্ষিণ চীন সাগরে তার আক্রমণাত্মক নীতির প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে কোয়াড নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পায়। এরপর থেকে নিয়মিত বৈঠক, নৌ-মহড়া (বিশেষত মালাবার নৌ-মহড়া) এবং উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০২২ সালে টোকিওতে সরাসরি বৈঠক হয়।
কোয়াড মূলত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সাপ্লাই চেইন, সাইবার সিকিউরিটি, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্বের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করে। তবে এর সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব
চলতি গ্রীষ্মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ভারতীয় কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়ে এবং নভেম্বরের জন্য পরিকল্পিত কোয়াড সম্মেলনের প্রক্রিয়া আটকে যায়। কর্মকর্তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটুক, তারপরেই তারা উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করবে।
ভারতের অবস্থান হলো, বাণিজ্যিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও কৌশলগত সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া উচিত। তবে বাস্তবতা হলো—বাণিজ্যিক চাপ এখন কূটনৈতিক এজেন্ডাকেও প্রভাবিত করছে।
জাপানের রাজনৈতিক অস্থিরতা
জাপানে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা পদত্যাগ করেছেন। তার পর নতুন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। নতুন নেতৃত্ব গঠনের পর দেশটির ফোকাস থাকবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এলডিপি নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকা সানায়ে তাকাইচি ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে প্রয়োজনে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি পুনঃআলোচনা করতে পারেন। ফলে টোকিওর মনোযোগ এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে সরে ঘরোয়া রাজনীতিতে কেন্দ্রীভূত।
ভারতের নির্বাচনী ব্যস্ততা
নভেম্বরের প্রথম ভাগে বিহার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন টানটান উত্তেজনায় ভরা। মোদি সরকারও পুরোপুরি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের জন্য সময় ও মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
ডিসেম্বরের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চাপ দিচ্ছে—রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা বন্ধ করতে এবং ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ছাড় প্রত্যাহার করতে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এইচ-১বি ভিসার ফি বাড়িয়ে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত করা হয়েছে, যা সরাসরি ভারতীয় আইটি শিল্পকে প্রভাবিত করছে। ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন, ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এবং জ্বালানি কেনা এখন সরাসরি বাণিজ্য আলোচনার সঙ্গে যুক্ত।
কূটনৈতিক অচলাবস্থা
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সময় কোয়াড দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একত্রিত হলেও কোনো যৌথ সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। এমনকি সম্মেলনের জন্য হোটেল বুকিং বা প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও হয়নি। কূটনৈতিক মহলে তাই ধারণা, চার দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সম্মেলন এ বছর আর হচ্ছে না।
ভারতের অবস্থান
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, কোয়াডকে ভারত একটি মূল্যবান ফোরাম হিসেবে দেখে যেখানে যৌথ স্বার্থের নানা বিষয় আলোচনায় আসে। তবে নেতাদের পর্যায়ের সম্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে চার দেশের কূটনৈতিক পরামর্শের মাধ্যমে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোয়াডের মূল শক্তি তার রাজনৈতিক ও কৌশলগত ঐক্যে। তবে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও রাশিয়া-চীন প্রভাব মোকাবিলার চাপে এই জোট বারবার ব্যাহত হচ্ছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকলেও কোয়াড দেশগুলো যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট সামাল দিতে ব্যর্থ হয়, তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
কোয়াড সম্মেলন কেবল একটি কূটনৈতিক বৈঠক নয়, বরং চীনের প্রভাব মোকাবিলার একটি প্রতীকী উদ্যোগ। অথচ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বাণিজ্যিক বিরোধ ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এ বছর এটির আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন এখন একটাই—ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করবে কে, যদি কোয়াড নিজেই স্থবির হয়ে পড়ে?