পর্যটন ঢেউয়ের সূচনা
২০১০ সালে আইসল্যান্ডের আইয়াফিয়াল্লাজোকুল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। আট দিন ইউরোপের আকাশপথ বন্ধ থাকে, বাতিল হয় এক লাখের বেশি ফ্লাইট, বিমান সংস্থাগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। তবে এই দুর্যোগ বিশ্ববাসীকে আইসল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে টেনে আনে—কালো বালুর সৈকত, হিমবাহ, ভূতাপীয় উষ্ণ জলাশয় ও পাহাড়ি জলপ্রপাত একে পরিণত করে জনপ্রিয় গন্তব্যে।
অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে আইসল্যান্ড কঠিন সময় পার করছিল। বেকারত্ব বেড়ে গিয়েছিল ৯ শতাংশে, মুদ্রার মান কমে যায় অর্ধেকে। এ অবস্থায় পর্যটন হয়ে ওঠে নতুন ভরসা। ২০১২ সাল থেকে স্বল্প খরচের এয়ারলাইন্স সহজে যাতায়াতের সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে আইসল্যান্ডিক ‘ওয়াও এয়ারলাইনস’ ইউরোপ-আমেরিকা ফ্লাইটে যাত্রীদের ফ্রি স্টপওভার দেয়, ফলে দেশটি দ্রুত পর্যটনকেন্দ্রে রূপ নেয়।
পর্যটন প্রবাহ ও জনজীবনে প্রভাব
২০১০ সালে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৫ লাখেরও কম, আর ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ২৩ লাখে। রাজধানী রেইকিয়াভিকের অর্থনীতি এখন মূলত পর্যটননির্ভর। শহরের প্রধান সড়কজুড়ে রঙিন দোকান, ট্রোল খেলনা, ভাইকিং মূর্তি, আগ্নেয় শিলা বিক্রি হয় পর্যটকদের জন্য। অনেক পুরনো ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, জায়গা নিয়েছে ক্যাফে, হোটেল, রেন্টাল সার্ভিস।
স্থানীয়দের দ্বন্দ্ব
দক্ষিণ আইসল্যান্ডের গ্রাম ভিকে বেড়ে ওঠা হেলগা গুদরুন বলেন, পর্যটন কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুবিধা এনেছে ঠিকই, তবে অনেক সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। কৃষকের জমিতে গাড়ি পার্ক করা, অনুমতি ছাড়া ঘোড়াকে খাওয়ানো, এমনকি এক ঘোড়ার মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। জুলাই মাসে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়, অতিরিক্ত পর্যটকে ভিকের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সামাজিক কাঠামোয় পরিবর্তন
ভিক একসময় কৃষিনির্ভর ছিল। এখন প্রতিটি দ্বিতীয় খামার গেস্টহাউস বা বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্টে রূপ নিয়েছে। সারা বছর ব্যবসা চলছে, নতুন রেস্টুরেন্ট, ব্রুয়ারি, এমনকি ‘লাভা শো’ও শুরু হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বিদেশি কর্মী। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, এমনকি খেলার মাঠে নোটিশ লাগানো হয়েছে যে, পর্যটকরা যেন শিশুদের ছবি না তোলে।
রাজধানীতে সংস্কৃতির টানাপোড়েন
রেইকিয়াভিকে পর্যটনের ঢেউ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। অনেক সংগীত আসর বন্ধ হয়ে হোটেল কক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। স্থানীয় সংগীতশিল্পী ও ডিজে ওলি ডোরি বলেন, পর্যটনের কারণে বিশেষ শ্রোতাদের মেলবন্ধন ভেঙে গেছে। স্থানীয়রা স্বীকার করেন, অর্থনীতির জন্য পর্যটন অপরিহার্য, তবে অবারিত পর্যটন আইসল্যান্ডের স্বকীয়তা হারিয়ে দিতে পারে।
গবেষকদের সতর্কতা
আইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ ক্যাট্রিন আনা লুন্ড বলেন, শুধু কয়েকটি নির্দিষ্ট গন্তব্য দেখার সংস্কৃতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। দেশের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিম ফিয়র্ডস–এর মতো জায়গাগুলোকে জনপ্রিয় করতে হবে। স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে আনলে পর্যটকরা দীর্ঘ সময় থাকতে আগ্রহী হবে।
আইসল্যান্ডবাসীদের একটি প্রবাদ আছে—‘থেটা রেডডাস্ট’ অর্থাৎ সব ঠিক হয়ে যাবে। পর্যটন সত্যিই দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। তবে আজ আইসল্যান্ডবাসীরা নতুন করে ভাবছেন, এই পরিবর্তন কতটা টেকসই এবং সংস্কৃতি ও সমাজের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য। অনেকের মতে, পর্যটনের মধুচন্দ্রিমা শেষের পথে।