০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭৮) রাশিয়া, চীন ও ইরানের মাঝের অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তন দেশবাসীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন তারেক রহমান নরওয়ের বড়দিনে বিতর্কিত খাবার লুটেফিস্কের প্রত্যাবর্তন, ঐতিহ্যেই ফিরছে স্বাদ প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৫) নিউজিল্যান্ডে গ্যাং প্রতীক নিষিদ্ধ: রাস্তায় শান্তি, কিন্তু অপরাধ কি সত্যিই কমল সৌদিতে বিরল তুষারপাতের পর প্রশ্ন: সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কি আবার তুষারপাত সম্ভব? যে রিকশায় গুলিবিদ্ধ হন হাদি, সেই চালকের আদালতে জবানবন্দি তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে আমরা জয়ী হবো: মির্জা ফখরুল পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে কে-৪ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা ভারতের

৪৫ দিন যেন ৪৫ বছরের মতো: গাজার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

যুদ্ধের ভেতর থেকে লেখা এক তরুণীর দিনলিপি

মাত্র ২১ বছর বয়সে গাজার তরুণ সাংবাদিক প্লেস্টিয়া আলাকাদ প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ করলেন ভয়াবহ এক যুদ্ধ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যখন ইসরায়েলি বোমা তার বাড়ির আশপাশে পড়তে শুরু করে, তখন তিনি ক্যামেরা ও কলম হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। টানা ৪৫ দিন তিনি গাজার ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ও গল্প তুলে ধরেন—তারপর আশ্রয় নেন অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে তিনি এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতাই স্থান পেয়েছে তাঁর প্রথম বই “দ্য আইজ অব গাজা: এ ডায়েরি অব রেজিলিয়েন্স”-এ।


যুদ্ধের স্মৃতি ও ট্রমা

Teen Vogue-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আলাকাদ জানান, বইয়ের জন্য নিজের ডায়েরি পুনরায় পড়তে গিয়ে তিনি বারবার ভেঙে পড়েছেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই ভয়াল সময়ে — যখন এক আশ্রয় থেকে অন্য আশ্রয়ে দৌড়াচ্ছিলেন, বন্ধু ও পরিবারের খোঁজ নিচ্ছিলেন, আর চারপাশে মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়াবহতা দেখতে দেখতে বাস্তববোধ হারিয়ে ফেলছিলেন।
তিনি বলেন, “প্রতিবার পড়লে মনে হয়—এটা কি সত্যিই ঘটেছিল? আমি কি সত্যিই এর মধ্য দিয়ে গেছি? গাজার মানুষ এখনো কি একইভাবে বেঁচে আছে?”

45 days felt like 45 years': Palestinian journalist Plestia Alaqad publishes memoir of her reporting in Gaza - Culture - Images

‘সংঘাত নয়, গণহত্যা’

এই তরুণ লেখিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গাজায় যা ঘটছে, তা “সংঘাত” নয়, বরং “গণহত্যা”। তাঁর মতে, এটিকে সংঘাত বলা কাপুরুষোচিত। তিনি প্রশ্ন তোলেন—“যদি এটা ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ হয়, তাহলে কেন শিশু, নারী, বৃদ্ধ—সবাই মারা যাচ্ছে, অনাহারে ভুগছে?”

ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবরের হাসপাতাল বোমা হামলায় ৫০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো বিশ্বজগৎ এবার জেগে উঠবে। কিন্তু সেটিই ছিল আরও ভয়াবহ সময়ের সূচনা।


সংবাদমাধ্যম ও নীরবতার ভয়

আলাকাদ গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। তাঁর ভাষায়, “আমরা যেন এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে বেঁচে আছি, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, আর সাংবাদিকদের নিজেদের ভাষা নিয়েও ভয় পেতে হয়।”

তিনি বলেন, অনেক সাক্ষাৎকারই প্রচারিত হয়নি বা বিকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। “বিশ্ব যেন চায় ফিলিস্তিনিরা ‘পারফেক্ট ভিকটিম’ হোক—নীরব, নির্ভরশীল, অভিযোগহীন।”


আশার আলো তরুণদের মধ্যে

সব অন্ধকারের মাঝেও তিনি আশার আলো দেখেছেন বিশ্বের তরুণদের মধ্যে—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে।
তিনি বলেন, “বিশ্ব এখন অন্তত আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে জানে। তবে আমি চাই এমন এক পৃথিবী, যেখানে কেউ আমাদের নিয়ে জানতে না হয়—যেখানে এই বইটারও প্রয়োজন হতো না।”

Israel's wars keep following me': Palestinian journalist Plestia Alaqad on her move to Lebanon | ITV News

‘গাজার বাইরে তুমি শুধু একজন দর্শনার্থী’

আলাকাদ স্বীকার করেন, বিদেশে এসে প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি হয়তো নিরাপদে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝেছেন, গাজাতেই তিনি সবচেয়ে স্বাধীন ছিলেন।
“গাজার বাইরে তুমি শুধু একজন দর্শনার্থী।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বই প্রচারের জন্য ভিসা আবেদনও করেননি — কারণ, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি।


যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের অসহনীয় বাস্তবতা

গাজার নারীরা যে কত কষ্টে আছে, সেটিও তুলে ধরেছেন তিনি। আলাকাদের ভাষায়, “নারীদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যপণ্য প্রায় অদৃশ্য। যেগুলো আছে, সেগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। তাবু পাওয়া যায় না, আর তাবু পেলে পরিষ্কার টয়লেট থাকে না।”

তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হলো—গাজার শিশুরা শিশু হতে পারে না, তরুণরা তরুণ থাকতে পারে না। যুদ্ধ তাদের খুব দ্রুত বড় করে দিয়েছে।”

Israel kills another Palestinian journalist in Gaza - Prensa Latina

‘গণহত্যা আমাদের শেখাল জীবনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে’

কেফিয়াহ পরার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আলাকাদ বলেন, “এই গণহত্যা আমাদের আগের জীবনকেও মূল্য দিতে শিখিয়েছে—যদিও সেটিও নিখুঁত ছিল না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখন ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলা অসম্ভব, কারণ গণহত্যার সময়ে সংস্কৃতি নিয়েও কথা বলা যায় না।”


যুদ্ধের অবসান নেই

যদিও আলাকাদের মতো মানুষের গল্প বিশ্বজুড়ে নাড়া দিচ্ছে, গাজায় হামলা এখনো থামেনি। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হওয়ার পরও ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন — “গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করো।”

ইসরায়েলি সূত্র জানিয়েছে, ৭২৯ দিন ধরে চলা এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যদিও বিশ্ব এখনো অপেক্ষা করছে সহিংসতার প্রকৃত অবসানের জন্য।

জনপ্রিয় সংবাদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭৮)

৪৫ দিন যেন ৪৫ বছরের মতো: গাজার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

০৬:০০:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

যুদ্ধের ভেতর থেকে লেখা এক তরুণীর দিনলিপি

মাত্র ২১ বছর বয়সে গাজার তরুণ সাংবাদিক প্লেস্টিয়া আলাকাদ প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ করলেন ভয়াবহ এক যুদ্ধ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যখন ইসরায়েলি বোমা তার বাড়ির আশপাশে পড়তে শুরু করে, তখন তিনি ক্যামেরা ও কলম হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। টানা ৪৫ দিন তিনি গাজার ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ও গল্প তুলে ধরেন—তারপর আশ্রয় নেন অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে তিনি এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতাই স্থান পেয়েছে তাঁর প্রথম বই “দ্য আইজ অব গাজা: এ ডায়েরি অব রেজিলিয়েন্স”-এ।


যুদ্ধের স্মৃতি ও ট্রমা

Teen Vogue-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আলাকাদ জানান, বইয়ের জন্য নিজের ডায়েরি পুনরায় পড়তে গিয়ে তিনি বারবার ভেঙে পড়েছেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই ভয়াল সময়ে — যখন এক আশ্রয় থেকে অন্য আশ্রয়ে দৌড়াচ্ছিলেন, বন্ধু ও পরিবারের খোঁজ নিচ্ছিলেন, আর চারপাশে মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়াবহতা দেখতে দেখতে বাস্তববোধ হারিয়ে ফেলছিলেন।
তিনি বলেন, “প্রতিবার পড়লে মনে হয়—এটা কি সত্যিই ঘটেছিল? আমি কি সত্যিই এর মধ্য দিয়ে গেছি? গাজার মানুষ এখনো কি একইভাবে বেঁচে আছে?”

45 days felt like 45 years': Palestinian journalist Plestia Alaqad publishes memoir of her reporting in Gaza - Culture - Images

‘সংঘাত নয়, গণহত্যা’

এই তরুণ লেখিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গাজায় যা ঘটছে, তা “সংঘাত” নয়, বরং “গণহত্যা”। তাঁর মতে, এটিকে সংঘাত বলা কাপুরুষোচিত। তিনি প্রশ্ন তোলেন—“যদি এটা ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ হয়, তাহলে কেন শিশু, নারী, বৃদ্ধ—সবাই মারা যাচ্ছে, অনাহারে ভুগছে?”

ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবরের হাসপাতাল বোমা হামলায় ৫০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো বিশ্বজগৎ এবার জেগে উঠবে। কিন্তু সেটিই ছিল আরও ভয়াবহ সময়ের সূচনা।


সংবাদমাধ্যম ও নীরবতার ভয়

আলাকাদ গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। তাঁর ভাষায়, “আমরা যেন এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে বেঁচে আছি, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, আর সাংবাদিকদের নিজেদের ভাষা নিয়েও ভয় পেতে হয়।”

তিনি বলেন, অনেক সাক্ষাৎকারই প্রচারিত হয়নি বা বিকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। “বিশ্ব যেন চায় ফিলিস্তিনিরা ‘পারফেক্ট ভিকটিম’ হোক—নীরব, নির্ভরশীল, অভিযোগহীন।”


আশার আলো তরুণদের মধ্যে

সব অন্ধকারের মাঝেও তিনি আশার আলো দেখেছেন বিশ্বের তরুণদের মধ্যে—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে।
তিনি বলেন, “বিশ্ব এখন অন্তত আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে জানে। তবে আমি চাই এমন এক পৃথিবী, যেখানে কেউ আমাদের নিয়ে জানতে না হয়—যেখানে এই বইটারও প্রয়োজন হতো না।”

Israel's wars keep following me': Palestinian journalist Plestia Alaqad on her move to Lebanon | ITV News

‘গাজার বাইরে তুমি শুধু একজন দর্শনার্থী’

আলাকাদ স্বীকার করেন, বিদেশে এসে প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি হয়তো নিরাপদে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝেছেন, গাজাতেই তিনি সবচেয়ে স্বাধীন ছিলেন।
“গাজার বাইরে তুমি শুধু একজন দর্শনার্থী।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বই প্রচারের জন্য ভিসা আবেদনও করেননি — কারণ, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি।


যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের অসহনীয় বাস্তবতা

গাজার নারীরা যে কত কষ্টে আছে, সেটিও তুলে ধরেছেন তিনি। আলাকাদের ভাষায়, “নারীদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যপণ্য প্রায় অদৃশ্য। যেগুলো আছে, সেগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। তাবু পাওয়া যায় না, আর তাবু পেলে পরিষ্কার টয়লেট থাকে না।”

তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হলো—গাজার শিশুরা শিশু হতে পারে না, তরুণরা তরুণ থাকতে পারে না। যুদ্ধ তাদের খুব দ্রুত বড় করে দিয়েছে।”

Israel kills another Palestinian journalist in Gaza - Prensa Latina

‘গণহত্যা আমাদের শেখাল জীবনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে’

কেফিয়াহ পরার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আলাকাদ বলেন, “এই গণহত্যা আমাদের আগের জীবনকেও মূল্য দিতে শিখিয়েছে—যদিও সেটিও নিখুঁত ছিল না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখন ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলা অসম্ভব, কারণ গণহত্যার সময়ে সংস্কৃতি নিয়েও কথা বলা যায় না।”


যুদ্ধের অবসান নেই

যদিও আলাকাদের মতো মানুষের গল্প বিশ্বজুড়ে নাড়া দিচ্ছে, গাজায় হামলা এখনো থামেনি। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হওয়ার পরও ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন — “গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করো।”

ইসরায়েলি সূত্র জানিয়েছে, ৭২৯ দিন ধরে চলা এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যদিও বিশ্ব এখনো অপেক্ষা করছে সহিংসতার প্রকৃত অবসানের জন্য।