শতবর্ষ পেরিয়ে নতুন রূপে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডিইউ) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার—যা ১৯২২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত—এখন এক নতুন রূপ নিচ্ছে। একসময় যেখানে মাত্র ৭০০ শিক্ষার্থীর বসার ব্যবস্থা ছিল, সেই গ্রন্থাগারের ধারণক্ষমতা শিগগিরই বাড়ছে প্রায় ৩,৪০০ আসনে।
কিন্তু এই রূপান্তর শুধুমাত্র ভবন সম্প্রসারণ নয়; এটি ঐতিহ্য ও আধুনিক প্রযুক্তির এক সেতুবন্ধনও বটে।
ঐতিহ্যের ভাণ্ডার: মোগল ফরমান থেকে ১৯ শতকের পাণ্ডুলিপি
গ্রন্থাগারটির সংগ্রহশালায় রয়েছে ১৮ ও ১৯ শতকের বিরল পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ভাষার বই এবং তিনটি অমূল্য ফরমান—যা মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিজে জারি করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান রাজেশ সিং জানান, “এই ফরমানগুলো হিজরি ১০৮৭ সালে, অর্থাৎ ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা হয়েছিল।”
দুর্লভ বই বিভাগের তাকগুলোয় আরও পাওয়া যায় জর্জ মেরেডিথের Poems (১৮০৮), এ.ডব্লিউ. কিংলেকের Eothen (১৮৬৩), ১৮ ও ১৯ শতকের তিব্বতি পাণ্ডুলিপি এবং খ্রিষ্টাব্দ ৭৫০ সালের ভারতের মানচিত্র।
বিনয়ী সূচনা থেকে বিশাল সংগ্রহ
১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারটির হাতে ছিল মাত্র ১,৩৮০টি দানকৃত বই ও ৮৬টি পত্রিকা। শুরুতে এটি ছিল অস্থায়ী ভবনে।
১৯৩৩ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এটি ছিল ভাইস রিগাল লজের বলরুমে, এরপর ১৯৫৮ সালে স্থানান্তরিত হয় বর্তমান ভবনে—শিল্প ও আইন অনুষদের মাঝখানে।
আজ সেখানে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ লাখেরও বেশি।
গ্রন্থাগারটির বুকশেলফগুলো তৈরি বার্মা টিক কাঠে, যা দান করেছিলেন মোরিস গায়ার—ডিইউ-এর সাবেক উপাচার্য ও ভারতের ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি।
এই তাকগুলোয় সংরক্ষিত রয়েছে ২৭,০০০-এরও বেশি থিসিস, যার প্রথমটি জমা পড়ে ১৯৫৮ সালে—“A Critical Study of Bhagavata Purana” শিরোনামে।
আধুনিকায়নের পথে: সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তি সংযোজন
দীর্ঘদিন ধরে গ্রন্থাগারের পিছনের জমি সম্প্রসারণের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এখন সেই পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পাচ্ছে।
“তিনটি নতুন চারতলা উইং নির্মিত হচ্ছে, যা মোট আয়তনকে ৪,৭৭৫ বর্গমিটার থেকে বাড়িয়ে ১৮,৫২৫ বর্গমিটারে নিয়ে যাবে,” জানান রাজেশ সিং।
১১০ কোটি রুপির এই আধুনিকায়ন প্রকল্পে থাকবে বায়োমেট্রিক গেট ও ধাতব চিপযুক্ত বই—যা ইস্যুর আগে ‘ডি-ম্যাগনেটাইজড’ না করলে বাইরে নেওয়া যাবে না।
প্রথম ধাপের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এবং তা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
ডিজিটাল সংরক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ
গ্রন্থাগারটি শুধু ভবন নয়, জ্ঞান সংরক্ষণের কেন্দ্র হিসেবেও এগিয়ে যাচ্ছে।
“পুরনো পাণ্ডুলিপি ও বিরল বইগুলো ডিজিটাইজ করার পরিকল্পনা চলছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগুলোর সহজ প্রবেশাধিকার পায়,” বলেন সিং।
এছাড়া, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি সিস্টেম (DULS)-এর কেন্দ্রবিন্দু, যার আওতায় রয়েছে ৩৪টি গ্রন্থাগার।
একসাথে এই নেটওয়ার্কে রয়েছে ১৭.৫ লাখ বই—যা ভারতের অন্যতম বৃহৎ একাডেমিক সংগ্রহ।
ডিইউ-এর ই-লাইব্রেরি পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এখন যে কোনো গ্রন্থাগারের ডিজিটাল ও বাস্তব বই এক প্ল্যাটফর্মেই ব্যবহার করতে পারছেন।
একইসঙ্গে, ব্রেইল গ্রন্থাগারও আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে, যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও পূর্ণ সুবিধা পান।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: ঐতিহ্য রক্ষা ও বিশ্বমানের সেবা
প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় ধাপের পরিকল্পনাও বাস্তবায়নের পথে যাবে।
রাজেশ সিংয়ের ভাষায়, “আমাদের লক্ষ্য শুধু বড় গ্রন্থাগার তৈরি করা নয়; বরং এমন একটি কেন্দ্র গড়ে তোলা, যা আধুনিক প্রযুক্তি, উৎকৃষ্ট সেবা ও ঐতিহ্যের সম্মিলন ঘটায়।”
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার আজ শতবর্ষের ঐতিহ্য পেরিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করছে—যেখানে মোগল যুগের ফরমান ও আধুনিক ডিজিটাল চিপ একই ছাদের নিচে মিলিত হচ্ছে জ্ঞান, ইতিহাস ও প্রযুক্তির এক অভিন্ন বন্ধনে।