নতুন আত্মজীবনীর এক অধ্যায়
ভোগ (Vogue) সাময়িকীতে প্রকাশিত মালালা ইউসুফজাইয়ের নতুন আত্মজীবনীর একটি অংশে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়—প্রেম, পারিবারিক চাপ এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী এই তরুণীর জীবনে যখন অগণিত বাধা, তখনই তিনি খুঁজে পান ভালোবাসার উষ্ণতা—আসের মালিকের মধ্যে।
প্রথম আলাপ ও সম্পর্কের শুরু
অক্সফোর্ডে পড়াশোনার সময় মালালার জীবনে শুরু হয় মানসিক ক্লান্তি ও আতঙ্কজনিত সমস্যার মধ্যে। সেই কঠিন পর্বে পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যানেজার আসের মালিকের কাছ থেকে পাওয়া ফোন কলগুলো হয়ে ওঠে তাঁর মানসিক আশ্রয়। প্রথমদিকে আসের কেবল তাঁর শারীরিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতেন, পরে আলাপ বাড়ে জীবনের নানা বিষয়ে—শৈশবের স্বপ্ন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, এমনকি বন্ধুদের প্রেমের গল্পও।
আসের একসময় কলেজে ডি-জে হিসেবে কাজ করতেন, কিন্তু লাহোরে এক অননুমোদিত পার্টিতে হত্যাকাণ্ড দেখার পর সেটি ছেড়ে দেন। মালালাও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, যা বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসা স্বীকার করেন, যদিও মালালার সম্পর্কের অভিজ্ঞতা ছিল একদম শিশুসুলভ — কখনো অভিমান, কখনো নাটুকে আচরণ, আর আসেরের ঠাট্টা-তামাশায় ভরা প্রতিক্রিয়া।

পরিবার ও সংস্কৃতির বাধা
তাদের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল সংস্কৃতি ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি। মালালা জানতেন, পশতুন পরিবারের কঠোর নিয়ম—“কোনো দেখা নয়, কোনো স্পর্শ নয়, কোনো প্রেম নয়।”
এক রাতে ফোনে আলাপে আসের মজার ছলে বলেছিলেন, তিনি মালালার বাবাকে চিঠি লিখে “দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে” গানের মতো নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবেন। সেই মুহূর্তে মালালার মনে হয়েছিল—তিনি যেমন খারাপ গায়ক, তেমনই তাঁর জীবনে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।
গোপন ভালোবাসা ও প্রকাশের ভয়
আসেরের লন্ডন সফরে তাঁরা একসঙ্গে কাটান কিছু দিন। দিনে দেখা, রাতে ফোনালাপ—তাদের সম্পর্ক যেন নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাসে ভরা। একবার মালালা মায়ের অনুমোদিত পোশাক বদলে গোলাপি লেসের পোশাক পরে রেস্টুরেন্টে হাজির হন, আর আসের ফিসফিসিয়ে বলেন, “তুমি একদম সেক্স-বম্ব।” সেই লজ্জা আর আনন্দে মালালার মুখ লাল হয়ে ওঠে।
কিন্তু একই সঙ্গে বাড়তে থাকে ভয়—কোথাও যেন কেউ দেখে না ফেলে। একদিন লন্ডনের পার্কে হাঁটার সময় একজন নারী তাঁদের ছবি তুলতে উদ্যত হলে মালালা আতঙ্কে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। তখনই তিনি বুঝেছিলেন, গোপন সম্পর্ক চিরকাল গোপন রাখা যায় না।
বাবার সঙ্গে মুখোমুখি
অবশেষে প্লেনে ওঠার আগে মালালা ঠিক করেন, বাবাকে সব জানাবেন। রাজনৈতিক ও নারীবাদ নিয়ে যাঁর সঙ্গে তিনি সবসময় বিতর্ক করতেন, সেই বাবাকে এখন বলতে হচ্ছে নিজের প্রেমের কথা। কথাগুলো গুছিয়ে বলতে বলতে তিনি অবশেষে স্বীকার করলেন, “আমি একজনকে পছন্দ করি—রোমান্টিকভাবে।”

বাবা প্রথমে চুপ করে থাকলেন, কিন্তু তারপরই ফোন করে মাকে খবর দিলেন। ফোনের ওপাশ থেকে শোনা গেল, “না! সে কি পশতুন? তাকে পশতুন ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে।”
এরপর বাবা শান্তভাবে বললেন, “সে যদি এখানে আসে, দেখা করতে পারি। কিন্তু তোমার গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা নয়।”
মালালা ক্ষুব্ধ হলেও বুঝতে পারলেন, তাঁদের সংস্কৃতি এখনো মেয়ের স্বাধীন সম্পর্ক মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
পরিবারের সঙ্গে আসেরের প্রথম দেখা
পরিকল্পনা অনুযায়ী আসের এক ঘণ্টার জন্য মালালার বাসায় এলেন। ফুল হাতে একটু নার্ভাস লাগছিল তাঁকে। মা প্রশ্ন করলেন, তিনি কি পশতু ভাষা জানেন? আসের কষ্ট করে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করলেন—যথেষ্ট না হলেও অন্তত চেষ্টার জন্য প্রশংসা পেলেন।
ছোট ভাইরা গেম খেলছিল, বাবা অতিথি সামলাতে ব্যস্ত, আর মালালা দুশ্চিন্তায় কাতর। তবে আসেরের স্বাভাবিক আচরণ সবাইকে স্বস্তি দেয় — তিনি বাবার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করেন, ভাইদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন, এমনকি ছন্দে ছন্দে বিটবক্সও করেন। এক ঘণ্টা পর তিনি চলে গেলে মালালা মনে মনে স্বস্তি পেলেও ভেতরে ছিল গভীর শূন্যতা—যেন এক অংশ হারিয়ে গেল।
অস্ত্রোপচার ও পুনরুদ্ধার
এরপর মালালা বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যান মুখের স্নায়ু পুনর্গঠনের অস্ত্রোপচারের জন্য। হামলার পর থেকে মুখের একপাশ স্থির হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসক ড. টেসা হ্যাডলকের তত্ত্বাবধানে তিন ধাপে চলা সার্জারির প্রথম ধাপ সফল হয়।
অস্ত্রোপচারের পর প্লেনেই আসেরের বার্তা আসে—“তোমার মা-বাবা কিছু বলেছে?”
মালালা উত্তর দেন, তাঁরা সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন, সমাজ কী বলবে, সেই ভয়েই তাঁরা চিন্তিত। কিন্তু তিনি জানতেন, ভালোবাসা ত্যাগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
বিদায়ের মুহূর্ত
লন্ডনে ফিরে মালালা ও আসের দেখা করেন এক চীনা রেস্টুরেন্টে। তাঁর মুখ এখনো ফুলে আছে, কিন্তু আসেরের চোখে সেই একই ভালোবাসা। কয়েক মাস ধরে সম্পর্কের কোনো নাম না দিলেও, সেই রাতেই তারা বুঝতে পারেন—ভবিষ্যতে কিছুই আগের মতো থাকবে না।
মালালা ইউসুফজাইয়ের আত্মজীবনীর এই অধ্যায়টি কেবল প্রেমের গল্প নয়; এটি এক নারীর আত্ম-অনুসন্ধান, পরিবার ও সংস্কৃতির চাপের মধ্যে নিজের পরিচয় রক্ষা করার সংগ্রাম। তাঁর জীবনের মতোই সাহসী এই অধ্যায়ে দেখা যায়—নোবেলজয়ী মালালা যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তেমনি নিজের হৃদয়ের সত্যকেও লুকিয়ে রাখেননি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















