সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, প্রস্তাবিত ‘আপার হাউস’ (Upper House) গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশের সংসদীয় কাঠামোয় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না; বরং এটি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা আরও বাড়াবে। সংস্থাটি প্রস্তাবটির পরিবর্তে বিদ্যমান সংসদ ব্যবস্থার ভেতরেই জবাবদিহিতা জোরদারের পরামর্শ দিয়েছে।
দ্বৈত সংসদ নয়, বিদ্যমান কাঠামোয় সংস্কারের তাগিদ
রাজধানীর এক হোটেলে বৃহস্পতিবার আয়োজিত ‘জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত আপার হাউস: এটি কি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবে?’ শীর্ষক সেমিনারে এই মতামত জানায় সিপিডি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান ওয়েস্টমিনস্টার-ধারী সংসদীয় কাঠামোয় ‘আপার হাউস’ গঠনের কোনো যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই।
‘আপার হাউস’-এর বদলে পার্লামেন্ট কমিশন প্রস্তাব
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, জাতীয় ঐক্য কমিশনকে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কক্ষ নিয়ে আলোচনা না করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তাঁর প্রস্তাব, ‘আপার হাউস’-এর পরিবর্তে একটি “পার্লামেন্ট কমিশন” গঠন করা যেতে পারে, যা সংসদের তৃতীয় চোখ হিসেবে কাজ করবে এবং স্পিকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়তা করবে।
স্পিকারকে শক্তিশালী করতে স্বাধীন কমিশনের আহ্বান
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মোয়াজ্জেম বলেন, সংসদের স্পিকার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অসহায় বোধ করেন। একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হলে স্পিকারকে আরও ক্ষমতাবান করা সম্ভব এবং সংসদীয় কার্যক্রম হবে অধিকতর স্বচ্ছ ও কার্যকর।
তিনি উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের ওয়েস্টমিনস্টার মডেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহিতা প্রায় অনুপস্থিত। আইন প্রণয়নের ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই শাসক দল একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে।”
কার্যকর কমিটি গঠনের ওপর জোর
মোয়াজ্জেম বলেন, সংসদে প্রায় ৫০টি স্থায়ী কমিটি থাকলেও অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। “যদি এসব কমিটি সক্রিয় থাকত, তাহলে আইন প্রণয়নে স্বাভাবিকভাবেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেত। বিদ্যমান কাঠামোতেই এই সংস্কার সম্ভব; আলাদা ‘আপার হাউস’ প্রয়োজন নেই,” যোগ করেন তিনি।
‘আপার হাউস’ দুর্বল ও অযৌক্তিক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিজাম আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত ‘আপার হাউস’-এর যুক্তি দুর্বল ও অযৌক্তিক। তাঁর মতে, নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল পর্যালোচনার জন্য আপার হাউসে পাঠানো হলেও সেখানে কোনো সংশোধনের ক্ষমতা না থাকলে তা অর্থহীন হয়ে যাবে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, “যদি আপার হাউস কেবল সুপারিশ দিতে পারে, তাহলে জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত হবে?”
অধ্যাপক আহমেদ আরও বলেন, আপার হাউস যদি অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়, তবে বিরোধী দল তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাব পেতে পারে। “দুই কক্ষের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা হবে, তা খুব সতর্কভাবে বিবেচনা করতে হবে,” বলেন তিনি।
সীমিত সমর্থন: স্বৈরাচার রোধে কেউ কেউ দেখছেন কার্যকারিতা
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম আংশিক সমর্থন জানিয়ে বলেন, দ্বিতীয় কক্ষ থাকলে শাসক দলের স্বৈরাচারী প্রবণতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। “যদি আপার হাউস থাকে, তবে শাসক দল ইচ্ছামতো আচরণ করতে পারবে না; এতে একধরনের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা তৈরি হবে,” মন্তব্য করেন তিনি।
তবে তিনি সতর্ক করেন, “এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”
বিদ্যমান কাঠামোতেই জবাবদিহিতা জোরদারের আহ্বান
সেশনের সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক রৌনক জাহান। তিনি সংসদ সদস্যদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
রৌনক জাহান বলেন, “নতুন কাঠামো পরীক্ষার আগে বিদ্যমান ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সংশোধন করা জরুরি। নীতিনির্ধারকদের উচিত বর্তমান কাঠামোয়ই জবাবদিহিতা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া।”
সিপিডির মতে, বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই বহুমাত্রিক। এর ভেতরে নতুন একটি ‘আপার হাউস’ যুক্ত করলে কার্যকারিতা নয়, বরং বিভ্রান্তি বাড়বে। সংস্থাটির পরামর্শ—প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, সক্রিয় সংসদীয় কমিটি এবং শক্তিশালী স্পিকারের মাধ্যমে বিদ্যমান কাঠামোয়ই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
#সিপিডি #আপার_হাউস #জাতীয়_সংসদ #বাংলাদেশ_রাজনীতি #UNB #সারাক্ষণরিপোর্ট