ভারতের মতো সুস্পষ্ট বৈষম্যময় দেশে সামাজিক শান্তি কীভাবে টিকে আছে—এই প্রশ্ন শুধু বিদেশি পর্যটক নয়, বরং দেশের শিক্ষিত, সচ্ছল নাগরিকদের মাঝেও ঘুরে বেড়ায়। বিলাসবহুল বাসা, গাড়ি ও গৃহকর্মীর জীবনধারার মাঝেও এমন প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায়: “এত বৈষম্যের পরও ভারতীয় শহরগুলো কেন রিও ডি জেনেইরো বা জোহানেসবার্গের মতো বিস্ফোরণ ঘটায় না?”
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ভারতীয় লেখক ও কলামনিস্ট মনু জোসেফ, তার আলোচিত বই “Why the Poor Don’t Kill Us”-এ। বইটি ইতোমধ্যেই দেশের নানা আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
ভারতের সামাজিক ভারসাম্যের ‘অদৃশ্য’ সূত্র
জোসেফের মতে, ভারতের শহরগুলোর বিশৃঙ্খল সৌন্দর্যই ধনীদের এক ধরনের নিরাপত্তা দেয়। শহরের অগোছালো ও কুৎসিত চেহারা গরিবদের মনে করিয়ে দেয়, তারাও এই চিত্রের অংশ—সম্পূর্ণ বাদ পড়ে যায়নি। এর সঙ্গে রয়েছে পুলিশি নির্মমতা, ভয়াবহ কারাগার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়—যা গরিব শ্রেণিকে বাধ্য করে নীরব থাকতে।
রাজনীতিবিদরা মাঝে মাঝে সুবিধা বিতরণ করে সেই নীরবতা বজায় রাখেন। ইংরেজি ও শিক্ষার প্রতি বিশ্বাস গরিবদের দেয় উন্নতির আশ্বাস। এমনকি ধনীদের চাকচিক্যও অনেক সময় প্রেরণা হিসেবে কাজ করে, কারণ তা গরিবদের স্বপ্ন দেখায় “একদিন আমিও পারব”।
বইয়ের যুক্তি ও সমালোচনা
জোসেফের বিশ্লেষণ পাঠককে আকৃষ্ট করে, মাঝে মাঝে গভীর পর্যবেক্ষণও দেয়, তবে অনেক সময় তা অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। বইটি শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে মূলত কারণ এটি তাদের এক ধরনের মানসিক স্বস্তি দেয়—যেন তাদের “সবচেয়ে বড় পাপ” কেবলই ‘ভালো উদ্দেশ্য থাকা’।
তবে তার এই ধারণা যে “ভারতের দরিদ্ররা বিদ্রোহ করে না”—তা ইতিহাসের বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। নকশাল আন্দোলনের উদাহরণই তা প্রমাণ করে। ১৯৬৯ সালে লেখিকা অরুন্ধতী রায় স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, কীভাবে নকশালরা এক চা-বাগান মালিককে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে হত্যা করেছিল। এমনকি ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভারতের “বিশাল এলাকা” নকশাল নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এই আন্দোলন দমন হয় মূলত রাষ্ট্রীয় দমননীতির কারণে, ভয় থেকে নয়। কিন্তু জোসেফের বই সেই সহিংস প্রেক্ষাপট এড়িয়ে গেছে।
শহরের ‘ভয়’ ও বাস্তবতা
বইটিতে লেখক শহরের ধনী পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহকর্মী, ড্রাইভার বা ওয়েটারদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের নিয়ে ভয়—“তারা আগের মতো অনুগত নেই”—একই সঙ্গে সহানুভূতিও প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে লেখকের এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবিজ্ঞানীরা ‘বিভ্রান্তি’ বলে উল্লেখ করবেন। কারণ, ভারতের শহুরে নিম্নবিত্ত সেবা শ্রেণি—যেমন ড্রাইভার, রাঁধুনি, ওয়েটার—আন্তর্জাতিক মানে গরিব হলেও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ। তাদের নিয়োগকর্তারাই প্রকৃত উচ্চবিত্ত।
তবু বইটি প্রশ্ন তোলে—“বিশ্বের অন্যতম বৈষম্যময় দেশে শ্রেণি শান্তি কেন বিদ্যমান?”—কিন্তু জোসেফের অনুসন্ধান সংকীর্ণ হয়ে যায় কেবল শহুরে সম্পর্কের ভেতরে।
গরিবদের ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’
জোসেফের সবচেয়ে প্রভাবশালী যুক্তি—“দরিদ্ররা নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু।” তিনি উল্লেখ করেন, দলিতদের মধ্যেও রয়েছে শ্রেণি ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্য।
তবে একই বিষয়কে আরও গভীরভাবে অন্বেষণ করেছেন সাংবাদিক ক্যাথরিন বু তার ২০১২ সালের বই “Behind the Beautiful Forevers”-এ। মুম্বাইয়ের এক বস্তিতে তিন বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে দরিদ্ররা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদেরই ক্ষতি করে, আর তাতে ধনীরা থেকে যান অক্ষত।
২০২৫ সালের বাস্তব প্রেক্ষাপট
আজকের ভারতে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। অর্থনীতি বাস্তব দামে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, গরিবের সংখ্যা কমেছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেড়েছে। মানুষ এখন আরও বড় প্রত্যাশা পোষণ করে, সুযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।
তবে এই প্রত্যাশাই হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। নাজুক অবকাঠামো, নিম্নমানের সরকারি সেবা এবং কর্মসংস্থানের সংকট তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ
মনু জোসেফের বইয়ের শিরোনাম অনুযায়ী, “দরিদ্ররা ধনীদের হত্যা করে না”—এটি হয়তো আজও সত্য। কিন্তু ভারতের উচ্চবিত্তদের জন্য বড় বিপদ বিদ্রোহ নয়, বরং আশাভঙ্গের তীব্রতা।
যে তরুণেরা প্রতিদিন নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সুযোগ না পায়—তাদের নীরব ক্ষোভই আগামী দিনের ভারতে বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে।