ভারতের প্রযুক্তিনগরী বেঙ্গালুরু একদিকে দেশের উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র, অন্যদিকে এক প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার প্রতীক। ট্রাফিক জট, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও নাগরিক সেবার অদক্ষতা—সব মিলিয়ে শহরটি এখন পরীক্ষার মুখে। রাজ্য সরকার যে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োগ করছে, তা সফল হলে ভারতের নগর শাসনে এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হতে পারে।
প্রযুক্তির শহরে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা
ভারতের তথাকথিত ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেঙ্গালুরু একদিকে যেমন দেশের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রাণকেন্দ্র, অন্যদিকে এটি এক প্রশাসনিক দুঃস্বপ্ন। সারা বছরই আরামদায়ক আবহাওয়া, বিশ্বমানের রেস্তোরাঁ, আড্ডামুখর কফিশপ ও নতুন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শহরটিকে আধুনিকতার প্রতীক বানিয়েছে। প্রযুক্তি শিল্পের সাফল্যে গড়ে উঠেছে এক নতুন বিলিয়নিয়ার শ্রেণি, যারা বিনিয়োগ করছে শিল্পকলা ও সংস্কৃতিতে। ভাড়াও তুলনামূলকভাবে সস্তা—দিল্লি ও মুম্বাইয়ের তুলনায় অনেক বেশি সহনীয়।
তবু, এর পেছনে লুকিয়ে আছে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নাগরিক দুর্ভোগের কাহিনি—রাস্তা ভাঙা, আলো নিভে থাকা, আবর্জনা জমে থাকা এবং এক অচল প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
যানজটে বন্দি শহর
বেঙ্গালুরু আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত ‘ট্রাফিক নরক’ হিসেবে। টমটম নামের নেভিগেশন সংস্থার সূচকে এটি বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহর। অফিসগামীদের অনেকেই তাই কর্মস্থলের কাছে বসবাস করেন, আর সামাজিক জীবনের পরিসর সীমিত হয়ে গেছে নিজেদের এলাকায়।
রাস্তার গর্ত, অপরিষ্কার পরিবেশ ও নষ্ট স্ট্রিটলাইট এই শহরের দৈনন্দিন বাস্তবতা। পাঁচ বছর আগে যেখানে এসব নিয়ে বছরে ৭৫ হাজারেরও কম অভিযোগ ছিল, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসেই সেই সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ছুঁয়েছে।
প্রশাসনিক বিপর্যয় থেকে সংস্কারের পথে
যদিও এই সমস্যাগুলো ভারতের অন্যান্য বড় শহরেও আছে, বেঙ্গালুরু বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে একটি দুঃসাহসী প্রশাসনিক সংস্কারের কারণে। ২০২৫ সালের শুরুতে কর্ণাটক রাজ্য সরকার শহরের বিদ্যমান মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ভেঙে পাঁচটি ছোট করপোরেশন গঠন করে, যেগুলো নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত গ্রেটার বেঙ্গালুরু অথরিটি (GBA)-এর অধীনে পরিচালিত হবে।
আগামী বছরের শুরুতে স্থানীয় নির্বাচন শেষে এই রূপান্তর সম্পূর্ণ হবে। সফল হলে এটি ভারতের অন্যান্য মহানগরের জন্যও এক নতুন শাসন মডেল হতে পারে।
ভারতের নগর শাসনের বৈষম্য
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শহরে বাস করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা অর্ধেকের কাছাকাছি। শহরগুলো জাতীয় অর্থনীতির কমপক্ষে ৬০% জিডিপি এবং অধিকাংশ প্রত্যক্ষ করের উৎস। কিন্তু সরকারি ব্যয় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের ভাগ অত্যন্ত কম—মাত্র ১৫% কর্মচারী ও ৩% সরকারি ব্যয় শহরকেন্দ্রিক।
যুক্তরাষ্ট্রে শহরগুলো জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে, আর চীনে এ হার অর্ধেকেরও বেশি। তুলনায়, ভারতের সংবিধান শহরের ক্ষমতা নির্ধারণে নীরব—রাজ্য সরকারের অধীনেই রয়েছে নগর প্রশাসন।
‘জন্মগত ত্রুটি’: বিকেন্দ্রীকরণের ব্যর্থতা
গ্রেটার বেঙ্গালুরু অথরিটির অন্যতম স্থপতি ভি. রাভিচন্দর একে বলেন, “ভারতের নগর প্রশাসনের জন্মগত ত্রুটি।” ১৯৯২ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাজ্য থেকে শহরে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ থাকলেও তা বাধ্যতামূলক করা হয়নি—ফলে অধিকাংশ রাজ্য তা বাস্তবায়ন করেনি।
এই ব্যবস্থায় শহরগুলো নিজস্ব অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক স্বাধীনতা হারিয়েছে। রাজস্বের প্রধান উৎস কেবল সম্পত্তি কর; বাকি অংশ নির্ভর করে কেন্দ্র বা রাজ্যের অনুদানের ওপর। নির্বাহী ক্ষমতা থাকে রাজ্য নিযুক্ত আমলাদের হাতে, রাজনৈতিক দায়িত্বও রাজ্যের। মেয়ররা কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতীক, আর স্থানীয় নির্বাচন প্রায়ই বিলম্বিত বা বাতিল হয়। বেঙ্গালুরুতে টানা পাঁচ বছর কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই; মুম্বাইয়ের শেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৭ সালে।
সমন্বয়ের অভাবে বিপর্যস্ত নগরব্যবস্থা
বেঙ্গালুরু শহর পরিচালনা করছে অসংখ্য সরকারি সংস্থা—যেমন পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য BDA ও BMRDA, পানি সরবরাহের জন্য BWSSB, পরিবহনের জন্য BMTC ও BMRCL, আবাসনের জন্য KHB ও KSDB। এই বহুকেন্দ্রী প্রশাসন পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয়হীন এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত।
স্থানীয় নাগরিক উদ্যোগ ‘জনাগ্রহ’-এর প্রধান শ্রীকান্ত বিশ্বনাথনের ভাষায়, “ভারতের শহরগুলো অর্থনীতি বা প্রশাসনের স্বতন্ত্র ইউনিট নয়—ফলে শাসনে গভীর বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।”
নতুন কাঠামোর তিন দিক: বিকেন্দ্রীকরণ, সমন্বয় ও জবাবদিহি
নতুন গ্রেটার বেঙ্গালুরু অথরিটি (GBA) তিনটি মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করছে—
বিকেন্দ্রীকরণ: বড় করপোরেশনকে পাঁচটি ছোট করপোরেশনে ভাগ করে নাগরিকদের সঙ্গে প্রশাসনিক যোগাযোগ ও জবাবদিহি বাড়ানো। বর্তমানে বেঙ্গালুরুর জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ—এই কাঠামো প্রশাসনিক দায়িত্বকে স্থানীয় পর্যায়ে সহজ করবে।
কেন্দ্রীয় সমন্বয়: GBA বিভিন্ন সংস্থা ও করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় ঘটাবে, যাতে পরিকল্পনা, সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে সামঞ্জস্য আসে।
রাজনৈতিক দায়িত্ব: সংস্থার চেয়ারম্যান হলেন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী, সহ-চেয়ারম্যান বেঙ্গালুরু বিষয়ক মন্ত্রী। রাভিচন্দর বলেন, “রাজ্য সরকার বরাবরই শহরের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক ছিল। এবার তারা প্রকাশ্যে দায়িত্ব নিচ্ছে—রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জবাবদিহি এখন একই স্থানে একীভূত হয়েছে।”
সমালোচক ও আইনি বিতর্ক
সবাই এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন না। সাবেক নগরনীতি উপদেষ্টা আশ্বিন মহেশের মতে, “ছোট করপোরেশন গঠনই সমাধান নয়; বরং পুরনো মিউনিসিপ্যাল সংস্থাকে আরও ক্ষমতাশালী করা যেত।”
অন্য সমালোচকদের মতে, GBA ১৯৯২ সালের সাংবিধানিক সংশোধনের চেতনাকে লঙ্ঘন করছে, যা আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর রামনাথ ঝা লিখেছেন, “এটি শহরভিত্তিক ক্ষমতায়নের কফিনে শেষ পেরেক।”
এক পরীক্ষাগারে ভারতের নগর ভবিষ্যৎ
ভারতের শহরগুলো এখনো নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। রাজ্য সরকারগুলো স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে—এমন আশা ক্ষীণ। তাই গ্রেটার বেঙ্গালুরু অথরিটি এখন এক পরীক্ষাগার, যেখানে দেখা হবে—ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেও কি শহুরে শাসনব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব?
যদি এই উদ্যোগ সফল হয়, তবে এটি শুধু বেঙ্গালুরু নয়—সমগ্র ভারতের নগর শাসনের ভবিষ্যৎ পথনকশা বদলে দিতে পারে।
#বেঙ্গালুরু #ভারত #প্রশাসন #নগরশাসন #প্রযুক্তিনগর #সিলিকনভ্যালি #সারাক্ষণরিপোর্ট