০৪:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
রুশ গ্যাস প্ল্যান্টে ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলা, বড় অগ্নিকাণ্ড এআই ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ এখন ‘নিজস্ব প্ল্যান্টে ডিএমজে পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তর কোরীয় সেনার পলায়ন তরুণদের মধ্যে ক্যান্সারের বৃদ্ধি: কারণ ও প্রভাব বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানিকারকদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ তৎপরতা যশোর এখন বাংলাদেশের শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ওমানের দুর্ঘটনায় নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ চট্টগ্রামে পৌঁছেছে আট মাস পর ভারতে আটক ১২ বাংলাদেশি নাবিকের দেশে ফেরা নারী অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নে ইলা মিত্রের শতবর্ষে নওগাঁয় র‌্যালি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ভেনিজুয়েলা: সামরিক প্রস্তুতি ও দুর্বলতা

বাংলাদেশের বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক: কারণ, ঝুঁকি ও নিরাপত্তা নির্দেশনা

বাংলাদেশে বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রকাশ, অন্যদিকে ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ। প্রতিবছর শতাধিক মানুষ ও গবাদিপশু বজ্রপাতে মারা যায় বা আহত হয়। তবে সচেতনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।


প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতের অবস্থান

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এর মধ্যে বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাণঘাতী দুর্যোগগুলোর একটি। প্রতি বছর বহু মানুষ ও গবাদিপশু বজ্রপাতে প্রাণ হারায় কিংবা আহত হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে গড়ে প্রতি বছর ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে সরকারিভাবে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

তবে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কিছু সহজ নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক—বজ্রপাত কীভাবে ঘটে, কেন বাংলাদেশে এটি এত ঘন ঘন হয়, এবং নিরাপদ থাকতে হলে কী করা উচিত।


বজ্রপাত কী এবং এটি কীভাবে ঘটে

বজ্রপাত হলো ঝড়ো আবহাওয়ার সময় আকাশে দেখা বৈদ্যুতিক আলোর এক উজ্জ্বল ঝলকানি। এটি এক ধরনের আবহাওয়াজনিত একটি ঘটনা, যেখানে পানি, বাতাস ও বিদ্যুতের পারস্পরিক ক্রিয়ায় ঝড় সৃষ্টি হয়। এই কারণেই একে হাইড্রোমেটিওরোলজিক্যাল (জল–আবহবিজ্ঞানসংক্রান্ত) দুর্যোগ বলা হয়।

বজ্রগর্ভ মেঘের ভেতরে ক্ষুদ্র বরফকণা ও পানির কণা একে অপরের সঙ্গে দ্রুত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই ঘর্ষণ ও গতিবিধির ফলে মেঘের কিছু অংশে ধনাত্মক ও কিছু অংশে ঋণাত্মক চার্জ জমা হয়। যখন এই দুই বিপরীত চার্জের পার্থক্য অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে, তখন হঠাৎ স্ফুলিঙ্গের মতো যে বিদ্যুৎ নির্গত হয়, সেটিই হলো বজ্রপাত।

এই বিদ্যুৎ কখনও মেঘ থেকে মেঘে, কখনও একই মেঘের ভেতরে, আবার কখনও মেঘ থেকে মাটিতে নেমে আসে। বজ্রপাতের ফলে আশপাশের বাতাস অতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয়, আর এই প্রসারণ থেকেই সৃষ্টি হয় বজ্রধ্বনি বা থান্ডার।


কেন বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হয়

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় প্রাক্‌–বর্ষা (মার্চ–মে) ও বর্ষা (জুন–সেপ্টেম্বর) মৌসুমে। এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—

১. আবহাওয়াগত ধরন

বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণ দিকের উষ্ণ বায়ু উত্তর দিকের শীতল বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়, ফলে প্রবল বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা বেশি ও আর্দ্রতা থাকার কারণে উঁচু মেঘগঠন হয়, যা বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।

২. জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের হার দিন দিন বাড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাতাসে বেশি পরিমাণে পানি বাষ্পে পরিণত হয়, ফলে আরও বৃহৎ ও সক্রিয় মেঘগঠন হয়। গবেষকরা জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাতের তীব্রতা ও ঘনত্ব দুটোই বাড়ছে।

৩. ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও বজ্রপাতপ্রবণতার অন্যতম কারণ। দেশটি বঙ্গোপসাগর, ভারতীয় উপমহাদেশ ও মেঘালয় মালভূমির মাঝে অবস্থিত। এসব ভৌগোলিক উপাদান মিলেই জটিল আবহাওয়া তৈরি করে।

উত্তর–পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল পাহাড়ি ও জলাভূমিতে ভরপুর, যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়ায়। দক্ষিণ–পূর্ব উপকূলীয় ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলেও ঘন ঘন ঝড় হয়, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে।


বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কেন বাড়ছে

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক ও খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ। প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে বৈশাখ মাসে, তীব্র গরম, ধুলাবালি ও দূষণের কারণে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে দুপুরে, যখন মানুষ মাঠে বা খোলা জায়গায় কাজ করে। পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি, কারণ তারা মাঠে বা খোলা স্থানে বেশি সময় কাটান।

যদিও বজ্রপাত যেকোনো স্থানে হতে পারে, তবুও গ্রামীণ অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এক জায়গায় বেশি মানুষ থাকার কারণে বিপদের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

এছাড়া অনেক মানুষ বজ্রপাতের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেকে ভুল ধারণা বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, নিরাপদ আশ্রয় বা সঠিক পদক্ষেপ নেয় না।


বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি রোধে করণীয়

ঝুঁকি এড়ানোই নিরাপত্তার মূল উপায়। বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে নিচের পদক্ষেপগুলো কার্যকর হতে পারে—

১. জাতীয় বজ্রপাত নিরাপত্তা পরিকল্পনা

সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করে একটি জাতীয় বজ্রপাত নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে—

  • নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ
  • প্রচারণা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি
  • শিক্ষক, স্থানীয় নেতা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ
  • অ্যাপ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে দ্রুত আবহাওয়া সতর্কতা প্রচার

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।

২. বজ্রপাত প্রতিরোধক অবকাঠামো নির্মাণ

ভবন ও মানুষকে রক্ষা করতে ‘আর্থিং-ব্যবস্থা’ বা গ্রাউন্ডিং-ব্যবস্থা স্থাপন করা কার্যকর উপায়। এতে তামা বা ইস্পাতের দণ্ডগুলো মাটির নিচে পুঁতে ভবনের ধাতব অংশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যাতে বিদ্যুৎ নিরাপদে মাটিতে নেমে যায়।

নৌযানেও বজ্রনিরোধক দণ্ড ও গ্রাউন্ডিং ব্যবস্থা বসানো যেতে পারে।

৩. আবহাওয়া অধিদপ্তরের অ্যাপ ব্যবহার

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) একটি স্মার্টফোন অ্যাপ সরবরাহ করে, যা আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও ঝড়ের সতর্কতা জানায়। এই অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতে পারে এবং বাইরের কাজ পরিকল্পনা করতে পারে।

বিদ্যালয়, এনজিও ও কমিউনিটি সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এই অ্যাপ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো উচিত।

৪. ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা

কৃষক, নির্মাণশ্রমিক, জেলে ইত্যাদি পেশাজীবীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এসব এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও আর্থিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. ৩০:৩০ সূত্র শেখানো

বজ্রপাতের দূরত্ব নির্ণয়ে “৩০:৩০ সূত্র” খুব সহজ উপায়—
যদি বজ্রপাত দেখা ও থান্ডার শোনার মধ্যে ৩০ সেকেন্ডের কম সময় লাগে, তাহলে ঝড় খুব কাছে আছে এবং তৎক্ষণাৎ আশ্রয় নেওয়া উচিত।
শেষ থান্ডারের শব্দের পর অন্তত ৩০ মিনিট ঘরে থাকতে হবে।

কৃষক, জেলে ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই সূত্র শেখানো দরকার। এছাড়া তাদের রাবারের জুতা ব্যবহার বা কাঠ/প্লাস্টিকের সরঞ্জাম ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

৬. সচেতনতা বৃদ্ধি

গ্রামীণ এলাকায় লোকগীতি, নাটক ও গল্প বলার মাধ্যমে বজ্রপাতের নিরাপত্তা বার্তা প্রচার করা যেতে পারে। বিদ্যালয়ে সেমিনার, লিফলেট বিতরণ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া উচিত।

টেলিভিশন, রেডিও ও পত্রিকায় বাস্তব ঘটনার গল্প ও পরামর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে আরও সচেতন করা সম্ভব।

৭. তালগাছ রোপণ

তালগাছ প্রাকৃতিকভাবে বজ্রপাত আকর্ষণ করে, ফলে আশপাশের মানুষ ও স্থাপনা নিরাপদ থাকে। কিন্তু নগরায়ণের কারণে অনেক তালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ২০১৭ সালে সরকার গ্রামে তাল রোপণ অভিযানের উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাল রোপণ অভিযান পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের এতে যুক্ত করা যেতে পারে।


বজ্রপাতের সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরামর্শ

  • সম্পূর্ণ বন্ধ ভবনের ভেতর থাকা সবচেয়ে নিরাপদ।
  • ধাতব ছাদযুক্ত গাড়িও একটি নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে।
  • দরজা–জানালা বন্ধ রাখুন, ধাতব বস্তু, পানি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকুন।
  • খোলা জায়গা, উঁচু স্থান, লম্বা গাছ বা ছোট কুঁড়েঘর থেকে দূরে থাকুন।
  • একা কোনো গাছের নিচে দাঁড়াবেন না।
  • বজ্রপাতের সময় টেলিফোন বা বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করবেন না।
  • আশ্রয় না পেলে মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে বসুন, তবে মাটির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
  • জঙ্গলে থাকলে ছোট গাছের নিচু স্থানে আশ্রয় নিন।
  • পানিতে থাকলে তৎক্ষণাৎ স্থলে চলে আসুন; বজ্রপাতের সময় সাঁতার কাটা বা নৌযাত্রা এড়িয়ে চলুন।
  • নৌকায় থাকলে সম্ভব হলে সেতু বা পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নিন।

বজ্রপাত প্রকৃতির এক শক্তিশালী ঘটনা, তবে এটি প্রাণঘাতী না–ও হতে পারে—যদি সচেতনতা, পরিকল্পনা ও সাবধানতা অনুসরণ করা হয়। নিরাপদ আশ্রয় নির্মাণ, বিদ্যালয়ে বজ্রপাত নিরাপত্তা শিক্ষা, তালগাছ রোপণ ও বিএমডি আবহাওয়া অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি অনেক কমানো সম্ভব।

সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বজ্রপাতের ঝুঁকি থেকে আরও নিরাপদ করা যেতে পারে—মানুষ, গবাদিপশু ও সমাজ—সবার জন্যই।


#বজ্রপাত #বজ্রঝড় #প্রাকৃতিকদুর্যোগ #নিরাপত্তা #বাংলাদেশআবহাওয়া #বিএমডি #পরিবেশ #সচেতনতা #সারাক্ষণরিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

রুশ গ্যাস প্ল্যান্টে ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলা, বড় অগ্নিকাণ্ড

বাংলাদেশের বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক: কারণ, ঝুঁকি ও নিরাপত্তা নির্দেশনা

০২:৫০:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রকাশ, অন্যদিকে ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ। প্রতিবছর শতাধিক মানুষ ও গবাদিপশু বজ্রপাতে মারা যায় বা আহত হয়। তবে সচেতনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।


প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতের অবস্থান

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এর মধ্যে বজ্রঝড় ও বিদ্যুৎ চমক সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাণঘাতী দুর্যোগগুলোর একটি। প্রতি বছর বহু মানুষ ও গবাদিপশু বজ্রপাতে প্রাণ হারায় কিংবা আহত হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে গড়ে প্রতি বছর ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে সরকারিভাবে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

তবে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কিছু সহজ নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক—বজ্রপাত কীভাবে ঘটে, কেন বাংলাদেশে এটি এত ঘন ঘন হয়, এবং নিরাপদ থাকতে হলে কী করা উচিত।


বজ্রপাত কী এবং এটি কীভাবে ঘটে

বজ্রপাত হলো ঝড়ো আবহাওয়ার সময় আকাশে দেখা বৈদ্যুতিক আলোর এক উজ্জ্বল ঝলকানি। এটি এক ধরনের আবহাওয়াজনিত একটি ঘটনা, যেখানে পানি, বাতাস ও বিদ্যুতের পারস্পরিক ক্রিয়ায় ঝড় সৃষ্টি হয়। এই কারণেই একে হাইড্রোমেটিওরোলজিক্যাল (জল–আবহবিজ্ঞানসংক্রান্ত) দুর্যোগ বলা হয়।

বজ্রগর্ভ মেঘের ভেতরে ক্ষুদ্র বরফকণা ও পানির কণা একে অপরের সঙ্গে দ্রুত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই ঘর্ষণ ও গতিবিধির ফলে মেঘের কিছু অংশে ধনাত্মক ও কিছু অংশে ঋণাত্মক চার্জ জমা হয়। যখন এই দুই বিপরীত চার্জের পার্থক্য অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে, তখন হঠাৎ স্ফুলিঙ্গের মতো যে বিদ্যুৎ নির্গত হয়, সেটিই হলো বজ্রপাত।

এই বিদ্যুৎ কখনও মেঘ থেকে মেঘে, কখনও একই মেঘের ভেতরে, আবার কখনও মেঘ থেকে মাটিতে নেমে আসে। বজ্রপাতের ফলে আশপাশের বাতাস অতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয়, আর এই প্রসারণ থেকেই সৃষ্টি হয় বজ্রধ্বনি বা থান্ডার।


কেন বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হয়

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় প্রাক্‌–বর্ষা (মার্চ–মে) ও বর্ষা (জুন–সেপ্টেম্বর) মৌসুমে। এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—

১. আবহাওয়াগত ধরন

বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণ দিকের উষ্ণ বায়ু উত্তর দিকের শীতল বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়, ফলে প্রবল বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা বেশি ও আর্দ্রতা থাকার কারণে উঁচু মেঘগঠন হয়, যা বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।

২. জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের হার দিন দিন বাড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাতাসে বেশি পরিমাণে পানি বাষ্পে পরিণত হয়, ফলে আরও বৃহৎ ও সক্রিয় মেঘগঠন হয়। গবেষকরা জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাতের তীব্রতা ও ঘনত্ব দুটোই বাড়ছে।

৩. ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও বজ্রপাতপ্রবণতার অন্যতম কারণ। দেশটি বঙ্গোপসাগর, ভারতীয় উপমহাদেশ ও মেঘালয় মালভূমির মাঝে অবস্থিত। এসব ভৌগোলিক উপাদান মিলেই জটিল আবহাওয়া তৈরি করে।

উত্তর–পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল পাহাড়ি ও জলাভূমিতে ভরপুর, যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়ায়। দক্ষিণ–পূর্ব উপকূলীয় ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলেও ঘন ঘন ঝড় হয়, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে।


বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কেন বাড়ছে

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক ও খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ। প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে বৈশাখ মাসে, তীব্র গরম, ধুলাবালি ও দূষণের কারণে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে দুপুরে, যখন মানুষ মাঠে বা খোলা জায়গায় কাজ করে। পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি, কারণ তারা মাঠে বা খোলা স্থানে বেশি সময় কাটান।

যদিও বজ্রপাত যেকোনো স্থানে হতে পারে, তবুও গ্রামীণ অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এক জায়গায় বেশি মানুষ থাকার কারণে বিপদের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

এছাড়া অনেক মানুষ বজ্রপাতের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেকে ভুল ধারণা বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, নিরাপদ আশ্রয় বা সঠিক পদক্ষেপ নেয় না।


বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি রোধে করণীয়

ঝুঁকি এড়ানোই নিরাপত্তার মূল উপায়। বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে নিচের পদক্ষেপগুলো কার্যকর হতে পারে—

১. জাতীয় বজ্রপাত নিরাপত্তা পরিকল্পনা

সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করে একটি জাতীয় বজ্রপাত নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে—

  • নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ
  • প্রচারণা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি
  • শিক্ষক, স্থানীয় নেতা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ
  • অ্যাপ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে দ্রুত আবহাওয়া সতর্কতা প্রচার

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।

২. বজ্রপাত প্রতিরোধক অবকাঠামো নির্মাণ

ভবন ও মানুষকে রক্ষা করতে ‘আর্থিং-ব্যবস্থা’ বা গ্রাউন্ডিং-ব্যবস্থা স্থাপন করা কার্যকর উপায়। এতে তামা বা ইস্পাতের দণ্ডগুলো মাটির নিচে পুঁতে ভবনের ধাতব অংশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যাতে বিদ্যুৎ নিরাপদে মাটিতে নেমে যায়।

নৌযানেও বজ্রনিরোধক দণ্ড ও গ্রাউন্ডিং ব্যবস্থা বসানো যেতে পারে।

৩. আবহাওয়া অধিদপ্তরের অ্যাপ ব্যবহার

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) একটি স্মার্টফোন অ্যাপ সরবরাহ করে, যা আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও ঝড়ের সতর্কতা জানায়। এই অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতে পারে এবং বাইরের কাজ পরিকল্পনা করতে পারে।

বিদ্যালয়, এনজিও ও কমিউনিটি সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এই অ্যাপ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো উচিত।

৪. ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা

কৃষক, নির্মাণশ্রমিক, জেলে ইত্যাদি পেশাজীবীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এসব এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও আর্থিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. ৩০:৩০ সূত্র শেখানো

বজ্রপাতের দূরত্ব নির্ণয়ে “৩০:৩০ সূত্র” খুব সহজ উপায়—
যদি বজ্রপাত দেখা ও থান্ডার শোনার মধ্যে ৩০ সেকেন্ডের কম সময় লাগে, তাহলে ঝড় খুব কাছে আছে এবং তৎক্ষণাৎ আশ্রয় নেওয়া উচিত।
শেষ থান্ডারের শব্দের পর অন্তত ৩০ মিনিট ঘরে থাকতে হবে।

কৃষক, জেলে ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই সূত্র শেখানো দরকার। এছাড়া তাদের রাবারের জুতা ব্যবহার বা কাঠ/প্লাস্টিকের সরঞ্জাম ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

৬. সচেতনতা বৃদ্ধি

গ্রামীণ এলাকায় লোকগীতি, নাটক ও গল্প বলার মাধ্যমে বজ্রপাতের নিরাপত্তা বার্তা প্রচার করা যেতে পারে। বিদ্যালয়ে সেমিনার, লিফলেট বিতরণ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া উচিত।

টেলিভিশন, রেডিও ও পত্রিকায় বাস্তব ঘটনার গল্প ও পরামর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে আরও সচেতন করা সম্ভব।

৭. তালগাছ রোপণ

তালগাছ প্রাকৃতিকভাবে বজ্রপাত আকর্ষণ করে, ফলে আশপাশের মানুষ ও স্থাপনা নিরাপদ থাকে। কিন্তু নগরায়ণের কারণে অনেক তালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ২০১৭ সালে সরকার গ্রামে তাল রোপণ অভিযানের উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাল রোপণ অভিযান পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের এতে যুক্ত করা যেতে পারে।


বজ্রপাতের সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরামর্শ

  • সম্পূর্ণ বন্ধ ভবনের ভেতর থাকা সবচেয়ে নিরাপদ।
  • ধাতব ছাদযুক্ত গাড়িও একটি নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে।
  • দরজা–জানালা বন্ধ রাখুন, ধাতব বস্তু, পানি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকুন।
  • খোলা জায়গা, উঁচু স্থান, লম্বা গাছ বা ছোট কুঁড়েঘর থেকে দূরে থাকুন।
  • একা কোনো গাছের নিচে দাঁড়াবেন না।
  • বজ্রপাতের সময় টেলিফোন বা বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করবেন না।
  • আশ্রয় না পেলে মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে বসুন, তবে মাটির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
  • জঙ্গলে থাকলে ছোট গাছের নিচু স্থানে আশ্রয় নিন।
  • পানিতে থাকলে তৎক্ষণাৎ স্থলে চলে আসুন; বজ্রপাতের সময় সাঁতার কাটা বা নৌযাত্রা এড়িয়ে চলুন।
  • নৌকায় থাকলে সম্ভব হলে সেতু বা পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নিন।

বজ্রপাত প্রকৃতির এক শক্তিশালী ঘটনা, তবে এটি প্রাণঘাতী না–ও হতে পারে—যদি সচেতনতা, পরিকল্পনা ও সাবধানতা অনুসরণ করা হয়। নিরাপদ আশ্রয় নির্মাণ, বিদ্যালয়ে বজ্রপাত নিরাপত্তা শিক্ষা, তালগাছ রোপণ ও বিএমডি আবহাওয়া অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি অনেক কমানো সম্ভব।

সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বজ্রপাতের ঝুঁকি থেকে আরও নিরাপদ করা যেতে পারে—মানুষ, গবাদিপশু ও সমাজ—সবার জন্যই।


#বজ্রপাত #বজ্রঝড় #প্রাকৃতিকদুর্যোগ #নিরাপত্তা #বাংলাদেশআবহাওয়া #বিএমডি #পরিবেশ #সচেতনতা #সারাক্ষণরিপোর্ট