এই বছরের টানা ভারী বৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাপের প্রজনন অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীসহ কয়েকটি জেলায় সাপে কাটার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গবেষক ও পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাপের আবাসস্থল ও আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে।
সাপ প্রজননের পেছনের কারণ
বাসস্থানের পরিবর্তন ও পানিবদ্ধতা
দীর্ঘ বৃষ্টিতে সাপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল যেমন শুকনো মাটি, গর্ত ও ঝোপঝাড় ডুবে গেছে। ফলে সাপরা আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের বসতবাড়ি, গোয়ালঘর, ধানখেত ও পাটগাদার নিচে ঢুকে পড়ছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের গবেষকরা জানিয়েছেন, প্লাবিত অঞ্চলে সাপের চলাচল আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
প্রজনন মৌসুমে অনুকূল পরিবেশ
বর্ষাকালই সাপের প্রজনন মৌসুম। এই সময় ব্যাঙ, ইঁদুর ও ছোট প্রাণীর সংখ্যা বাড়ায় সাপদের খাদ্য সরবরাহও প্রচুর থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টানা বৃষ্টি ও আর্দ্র মাটির কারণে ডিম থেকে নবজাতক সাপ বের হওয়ার পর তাদের বেঁচে থাকার হার ২০–২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
খাদ্য চক্র ও শিকার বাড়ার সুযোগ
বৃষ্টির ফলে জলাশয় ও মাঠে ব্যাঙ, কেঁচো, মাছ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। এই কারণে সাপদের খাদ্যচক্র শক্তিশালী হচ্ছে এবং তাদের সক্রিয়তাও বেড়েছে। বিশেষ করে রাসেল’স ভাইপার, গোখরা ও দুধরাজের মতো প্রজাতিগুলো এখন আগের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।
নতুন এলাকা দখল ও বিস্তার
বন্যা ও অতিরিক্ত জলপ্রবাহের কারণে সাপ এখন নতুন এলাকাগুলোতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ বা ঘাসের সঙ্গে তারা নদী ও খাল পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে আগে যেখানে সাপের উপস্থিতি কম ছিল, সেখানেও এখন সাপে কাটার ঘটনা ঘটছে।
সাপে কাটার উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় হাসপাতালের তথ্যমতে, চলতি বছরে সাপে কাটায় আক্রান্ত প্রায় ১৫,০০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৮৪ জন মারা গেছেন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে গত নয় মাসে এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে ২০৬ জন বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত। লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায়ও বন্যার সময় সাপে কাটার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক সাপ প্রজনন ও সাপে কাটার হটস্পট
জেলা | প্রজনন বৃদ্ধির কারণ | সাপে কাটার পরিস্থিতি |
রাজশাহী | মাঠ, বালুচর ও নদীসংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী প্লাবন; শুকনো জায়গার অভাব | হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ — এক হাজারের বেশি |
লক্ষ্মীপুর | বন্যা ও জলাবদ্ধতা বাড়ির ভেতর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে | গত দুই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ |
নোয়াখালী | কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলায় প্লাবনের কারণে সাপ আশ্রয় বদলাচ্ছে | অন্তত ৩৫ জন আক্রান্ত |
ফেনী | অতিবৃষ্টি ও গরমে মাটির নিচের গর্ত নরম হয়ে গেছে | সাপে কাটার ঘটনা ক্রমবর্ধমান |
দিনাজপুর ও রংপুর | কৃষিজমি ও নদীর ধারে পানিবদ্ধতা | নতুনভাবে সাপ দেখা যাচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় |
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
পরিবেশবিদদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরণ অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হচ্ছে। এতে সাপের প্রজননচক্র আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, গড় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার বৃদ্ধি সাপের ডিম ফোটার সময়কে আরও অনুকূল করে তুলছে।
করণীয় ও সতর্কতা
- অ্যান্টিভেনম সরবরাহ বাড়ানো: প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
- গ্রামীণ সচেতনতা বৃদ্ধি: বৃষ্টির সময় জুতা পরে চলাফেরা, খোলা মাঠে না ঘুমানো, এবং রাতের অন্ধকারে টর্চ ব্যবহার করা জরুরি।
- দ্রুত চিকিৎসা: সাপে কাটার পর দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া ও কুসংস্কার এড়িয়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
- গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণ: প্রতিটি জেলায় সাপে কাটার রোগীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করলে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।
এই বছরের দীর্ঘস্থায়ী বর্ষা শুধু কৃষিকাজেই প্রভাব ফেলেনি, বরং বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনে নতুন বিপদ হিসেবে সাপে কাটার আশঙ্কা বাড়িয়েছে। প্রজনন মৌসুমের সঙ্গে মিলিত হয়ে অতিবৃষ্টি সাপের আচরণ ও চলাচলকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছে, যা জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা—উভয়ের জন্যই সতর্কবার্তা।
# সাপে_কাটা, #সাপের_প্রজনন, #জলবায়ু_পরিবর্তন, #রাজশাহী, #লক্ষ্মীপুর, #নোয়াখালী, #বন্যা, #বাংলাদেশ, #জনস্বাস্থ্য, #পরিবেশ