রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক জুলিয়া ইয়োফে তাঁর নতুন বই ‘মাদারল্যান্ড’–এ তুলে ধরেছেন রাশিয়ার বিস্মৃত নারীবাদী ইতিহাস। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিপ্লবী নারী, যুদ্ধের স্নাইপার, সোভিয়েত শাসকের পত্নী থেকে শুরু করে তাঁর নিজস্ব পূর্বপুরুষরা পর্যন্ত—দেশটির ইতিহাস ও বর্তমানকে গড়ে তুলেছেন।
জাতীয় বই পুরস্কারের জন্য মনোনীত এই নন-ফিকশন গ্রন্থে আত্মজীবনী, ইতিহাস ও সাংবাদিকতার মিশেলে ইয়োফে দেখিয়েছেন, সোভিয়েত যুগে নারীদের অধিকার যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা পরে কীভাবে মুছে যেতে শুরু করে, এবং সেই ভঙ্গুরতা আজও কীভাবে প্রতিধ্বনিত হয়।
নারীদের ইতিহাসে নতুন আলো
ইয়োফে বলেন, সাধারণত রাশিয়া বা সোভিয়েত ইতিহাস বলতে মানুষ লেনিন, স্তালিন বা পুতিনের মতো পুরুষ নেতাদেরই বোঝে। কিন্তু তাঁর বইয়ে আলো পড়েছে নারীদের ওপর—যারা কেবল দর্শক নয়, বরং পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
ভার্জিনিয়ায় নিজ বাসায় রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এই বই লেখার মাধ্যমে আমি বুঝেছি—অগ্রগতি কখনওই সরল বা স্থায়ী নয়। অনেক সময় এটি উল্টোদিক থেকেও প্রতিক্রিয়া আনে।”
বইটি লেখার প্রেরণা
ইয়োফে জানান, তাঁর এজেন্ট বিস্মিত হয়েছিলেন যে তাঁর মা, নানী ও প্রপিতামহী—তিন প্রজন্মই চিকিৎসক ছিলেন। “তাদের কাছে এটা ছিল ব্যতিক্রমী, কিন্তু আমার কাছে ছিল সাধারণ সোভিয়েত মধ্যবিত্ত জীবনের অংশ,” বলেন ইয়োফে।
তিনি আরও জানান, নিকিতা ক্রুশচেভের প্রপৌত্রী নিনা ক্রুশচেভা তাঁকে বলেছিলেন, “দেশের ভাগ্য যেমন, তেমনি তার শীর্ষ নারীদের জীবনও—সোভিয়েত প্রথম লেডিদের জীবন দিয়েই রাশিয়ার ইতিহাস বলা যায়।” এই ভাবনাই বইটির কাঠামো নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
পারিবারিক ইতিহাসের অনুসন্ধান
ইয়োফে বলেন, প্রকাশকরা যখন তাঁর পরিবার নিয়ে আরও জানতে চেয়েছিল, তিনি বুঝেছিলেন, এদের জীবন সাধারণ হলেও তারা বসবাস করছিল এক অসাধারণ সময়ের মধ্যে—মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামাজিক পরীক্ষার ভেতরে।
তিনি জানান, “আমি এমন এক প্রজন্মে বড় হয়েছি যারা সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি সংশয়ী ছিল। কিন্তু ইতিহাসবিদ স্টিফেন কটকিনের সঙ্গে কাজ শুরু করার পর দেখলাম, আমার পূর্বপুরুষদের অনেকেই একসময় সত্যিই এই আদর্শে বিশ্বাস করতেন।”

‘ছোট মানুষদের’ চোখে বড় ইতিহাস
ইয়োফে স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচের বই ‘সেকেন্ডহ্যান্ড টাইম’ থেকে প্রেরণা পান। আলেক্সিয়েভিচ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ‘ছোট মানুষদের’ চোখে তুলে ধরেছিলেন। ইয়োফে বলেন, “তিনি দেখিয়েছেন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার মানে কী। আমিও চেয়েছি সেই সাধারণ মানুষদের কণ্ঠ দিয়েই ইতিহাস বলতে।”
রাশিয়ার নারীবাদ ও বিস্মৃত ইতিহাস
ইয়োফে বলেন, “রাশিয়ানদের অনেকেই জানে না, তাদের দেশে নারীদের অধিকার অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কারণ ইতিহাস সবসময় ‘মহান পুরুষদের’ গল্প।”
তিনি উল্লেখ করেন, “পশ্চিমারা মনে করে তারা নারীবাদ উদ্ভাবন করেছে, কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার নিজস্ব এক সমৃদ্ধ ও ভিন্নধর্মী নারীবাদী ঐতিহ্য আছে। সোভিয়েত নারী আন্দোলন কখনোই নিজেদের ‘ফেমিনিস্ট’ বলে পরিচয় দেয়নি, কিন্তু তারা সমাজ বদলে দিয়েছে।”
অগ্রগতির ভঙ্গুরতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত নারীরা যখন বিজ্ঞানী, সৈনিক থেকে আবার গৃহিণীর ভূমিকায় ঠেলে দেওয়া হয়, ইয়োফে দেখিয়েছেন কীভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের পেছনে ঠেলে দেয়।
তিনি বলেন, “অগ্রগতি কখনোই স্থায়ী নয়। সোভিয়েত সরকার নারীদের কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দিতে উৎসাহী ছিল, আর নারীরাও ক্লান্ত ছিল। তারা একইসঙ্গে মা, গৃহিণী ও শ্রমিক—তিন ভূমিকায় অবসন্ন হয়ে পড়েছিল।”

মাতৃভূমি থেকে নির্বাসন
ইয়োফে জানান, তিনি দু’বার তাঁর ‘মাদারল্যান্ড’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন—প্রথমবার ১৯৯০ সালে ইহুদিবিদ্বেষের কারণে পরিবারসহ দেশত্যাগ করে, দ্বিতীয়বার পুতিনের শাসনে।
তিনি বলেন, “রাশিয়ায় এখন এমন পরিবেশ যেখানে ‘ফেমিনিস্ট’ শব্দসহ কোনো বই প্রকাশেরই সুযোগ নেই। তবুও আমি চাই রাশিয়ানরা যেন তাদের নিজ ইতিহাস জানতে পারে—even যদি বইটি গোপনে, ডিজিটাল ‘সামিজদাত’ পদ্ধতিতে ছড়িয়ে দিতে হয়।”
রাশিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি
ইয়োফে বলেন, “দুঃখজনক হলেও, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ তার অতীত ও বর্তমানের প্রতিচ্ছবির মতোই হবে। আমি এখনও মস্কোকে ভীষণ মিস করি, কিন্তু জানি অনেক দিন সেখানে ফেরা সম্ভব নয়। পুতিন ও পুতিনিজম দীর্ঘ সময় টিকে থাকবে।”
‘মাদারল্যান্ড’ শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, এটি রাশিয়ান নারীদের অজানা সংগ্রাম ও অগ্রগতির ভঙ্গুরতার দলিল। ইয়োফে দেখিয়েছেন—একটি সমাজ কীভাবে তার নারীদের ইতিহাসকে উপেক্ষা করলে সেই সমাজও নিজের ভবিষ্যৎ হারায়।
#রাশিয়া,# নারীবাদ,# জুলিয়া ইয়োফে,# মাদারল্যান্ড,# নারীর ইতিহাস, #বই, #সংস্কৃতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















