অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম-’এর এক নারী কর্মীর মৃত্যু সংবাদমাধ্যমের কর্মপরিবেশকে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে
যৌন হয়রানির অভিযোগ করে বিচার পাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা শূন্য। অর্থাৎ, একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। অথচ এমন অভিযোগ তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। কিন্তু কেউ মানছে না সেই আদেশ। আইন প্রয়োগেরও নেই কোনো উদ্যোগ।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, “গণমাধ্যম তো সমাজের বাইরের কিছু না। গোটা দেশেই যেখানে সুশাসনের অভাব রয়েছে, সেখানে গণমাধ্যমের কাছ থেকে পৃথক কিছু আশা করতে পারি না। দেশে যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন গণমাধ্যমেও পরিবর্তন আসবে। আদালত থেকে সিদ্ধান্ত এলে সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু কোনো সরকারই গণমাধ্যমে যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কমিটি গঠন করতে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের পথে হাটেনি। এখনও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।”
দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি শামসুল হক জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আদালতের যে আদেশ রয়েছে, সেটা বাস্তবায়নে প্রেস কাউন্সিল ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আদালত থেকে অনেক আদেশই আসে, অনেক কিছুরই বাস্তবায়ন হয় না। গণমাধ্যমে আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য কেউ তো তদারকি করছে না। সেই তদারকিটা প্রেস কাউন্সিল করতে পারে।”
ঢাকা স্ট্রিম ও একজন স্বর্ণময়ীর মৃত্যু
গত শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বাসা থেকে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৬) নামে এক নারী গণমাধ্যমকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিম-এর গ্রাফিক্স ডিজাইনার ছিলেন। প্রাথমিকভাবে তার এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করছে পুলিশ। স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যা নিয়ে ‘ঝড়’ বয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
শেরেবাংলানগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমাউল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে সুরতহাল রিপোর্টে এটাকে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেলে বোঝা যাবে এটা হত্যা, না আত্মহত্যা৷ আত্মহত্যা হলেও এই আত্মহত্যার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা সেটা নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।”
গত ১৩ জুলাই ঢাকা স্ট্রিম-এর ৭ জন নারীকর্মীসহ ২৮ জন সম্পাদকের কাছে একটা অভিযোগপত্র জমা দেন সংবাদমাধ্যমটির বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগের উল্লেখ করেন নারী কর্মীরা। তারপর আলতাফ শাহনেওয়াজকে নিউজ রুম থেকে সরিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। স্বর্ণময়ীর মৃত্যু এবং ঢাকা স্ট্রিমে তার যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনায় এলে ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ দাবি করে আলতাফ শাহনেওয়াজকে নিউজরুম থেকে সরিয়ে দেয়ায় সবকিছুর সুরাহা হয়ে গিয়েছে৷ তারা আরো দাবি করে, যৌন হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে কর্মীদের সঙ্গে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলে জানায় তারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২৮ জন অভিযোগকারীর মধ্যে তিনজনকে চাকরি থেকে অব্যহতির নোর্টিশ দেওয়া হয়। অভিযোগ দায়েরের তিন মাস পর ধানমন্ডির বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের লাশ।
স্বর্ণময়ীর মাসতুতো (খালাতো) ভাই সঞ্চয় অধিকারী একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “স্বর্ণময়ী ঢাকায় এসে আমার বাসায় উঠেছিল। আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওর বন্ধুর মতো সম্পর্ক। সবকিছু সে আমার স্ত্রীর কাছে শেয়ার করতো। গত জুলাই মাসে ঘটনার সময় স্বর্ণময়ী আমাকে বলেছিল, দাদা তুমিও তো প্রথম আলোতে ছিলে, তোমার সাবেক সহকর্মীদের ‘আচরণের’ কারণে তো এখানে চাকরি করা মুশকিল হয়ে গেছে। তুমি আমার অফিসে এসে তাদের একটু বলে যাও যে, আমি তোমার বোন। এরপর আমি ঢাকা স্ট্রিম অফিসে যাই। কিন্তু ওইদিন আলতাফ শাহনেওয়াজকে পাইনি। তবে সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদকে পেয়েছি। তার সঙ্গে আমার বোনের পরিচয় করিয়ে দেই এবং অন্য সহকর্মীদের সঙ্গেও আমার বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি। এরপর আমি মনে করেছি, বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর চারদিন আগে স্বর্ণময়ী আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কলে অনেকক্ষণ কথা বলে। তখন সে বলেছে, অফিসের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। তার পক্ষে আর চাকরি করা সম্ভব না। সে ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণায় আছে। আমার স্ত্রী বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি ওদের বাসায় গিয়ে কথা বলবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু কাজের চাপে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যেই ও আত্মহত্যা করলো।’’
সঞ্চয় অধিকারী জানান, ‘‘স্বর্ণময়ীর পরিবারের সবাই এখন গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। তিন দিনের অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়া শেষে তার পরিবারের লোকজন ঢাকায় ফিরলে আমরা আইনগতভাবে কী করণীয় সেটা ঠিক করবো। আপাতত একটা জিডি করা আছে। পুলিশকে আমি বলেছি, তদন্ত শুরু করতে। যে কোনো ধরনের সহযোগিতা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা করবো। আমরা চাই মিডিয়াতে যাতে আর কোনো নারী কর্মীকে এভাবে জীবন দিতে না হয়।”
স্বর্ণময়ীর মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে অনেক সংগঠন। অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, শাহীন আনাম, শীপা হাফিজা, রেখা সাহাসহ কয়েকজন এক বিবৃতিতে বলেছেন, এমন সব ঘটনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, গবেষক ও অধিকারকর্মী সায়দিয়া গুলরুখ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা ঢাকা স্ট্রিম-এর সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই চিঠিতে সুনির্দিষ্ট তদন্ত দাবি করে ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিক দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা৷ চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা উল্লেখ করেন, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ভিত্তিতে তাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত বিবৃতির বক্তব্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ মোকাবেলায় ঢাকা স্ট্রিমের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ বলে তারা মত প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ২৩৪ বিশিষ্টজন এক বিবৃতিতে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
আলতাফ শাহনেওয়াজের পরিবারের বক্তব্য
আলতাফ শাহনেওয়াজের স্ত্রী ফাতেমা আবেদীন নাজলা একাধারে সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী। স্বামীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “যে-কোনো মূল্যে স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। সেই তদন্তে যদি আমার স্বামী আলতাফ শাহনেওয়াজ দোষী সাব্যস্ত হন তার উপযুক্ত শাস্তি চাই। একইসঙ্গে মিডিয়া ট্রায়ালের ফলে আমার ও পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলোর প্রতিকার চাই। বিশেষ করে আমার ৬ বছর যাবত পরিচালিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সাইবার হামলা, আমার চারিত্রিক ও পেশাগত সততার বিষয়ে কুৎসা, আমার সন্তানকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কুৎসার বিষয়ে আইনি প্রতিকার আমি চাই।”
ঢাকা স্ট্রিম-এর দাবি
পুরো বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ঢাকা স্ট্রিম-এর সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ডয়চে ভেলেকে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলা হয়। ‘‘কর্মীরা অভিযোগ দেয়ার পর আপনি কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?’’ এ প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার মাহমুদ দাবি করেন, “গত ১৩ জুলাই ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কন্টেন্ট প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভাগের ২৮জন কর্মী অভিযোগ করেন। তাদের মধ্যে ৭ জন নারীর নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, বাকিরা সেই অভিযোগের প্রতি সমর্থন জানান। অভিযোগ পাওয়ার দিনই আমরা অভিযোগকারী সাতজন সহকর্মীর সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলি। পরে তাদের নিয়ে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলতাফ শাহনেওয়াজকে প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি অথবা বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের দুটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। অভিযোগকারী ৭ নারী সহকর্মী আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া এবং তার সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ না থাকা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন। অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে এর বাইরে আর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়নি। প্রস্তাব অনুযায়ী, তাৎক্ষণিকভাবে আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। একটি তদন্ত কমিটিও করা হয়। পরবর্তী তিন মাস শাহনেওয়াজকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই সময়ের মধ্যে আর কোনো নতুন অভিযোগ ওঠেনি।’’ তিনি আারো দাবি করেন, ‘‘আমরা সবাইকে উৎসাহিত করেছিলাম, যেন কোনো অসঙ্গতি দেখলে তা জানানো হয়। স্বর্ণময়ী বিশ্বাস ও অন্য নারী সহকর্মীদের মধ্যে কেউই এর মধ্যে নতুন কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেননি।”
তদন্ত কমিটি আইনানুগভাবে গঠন করা হয়েছিল কিনা জানতে চাওয়ায় ইফতেখার মাহমুদ বলেন, “আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন মরিয়ম আখতার সুমি (এক্সিকিউটিভ-এইচআর ও অ্যাডমিন) এবং পি. এম. সজল আহমেদ (হেড অব এইচআর)। প্রতিষ্ঠান তখন প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে থাকায় শ্রম আইন (সংশোধিত ২০২২)-এর পূর্ণ শর্তসমূহ সম্পূর্ণভাবে প্রতিপালন করে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেনি। তবে অভিযোগকারীরা যেন সুবিচার পান, সেটি নিশ্চিত করতে সামর্থ্য অনুযায়ী কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি।’’ ইফতেখার মাহমুদ প্রসঙ্গক্রমে জানান, ঢাকা স্ট্রিম গত ১২ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে সরকারি নিবন্ধন পায়।
অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা জানতে চাইলে ঢাকা স্ট্রিম-এর সম্পাদক ডয়চে ভেলেকে বলেন, “অভিযোগ পাওয়ার দিনই আমরা অভিযোগকারী সাতজন সহকর্মীর সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলি। পরে তাদের নিয়ে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।”
অভিযোগকারী এবং চাকরিচ্যুত নারী কর্মীর প্রতিবাদ
ঢাকা স্ট্রিম থেকে গত ৯ অক্টোবর চাকরিচ্যুতির নোর্টিশ পেয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে একজন নারী এবং দুইজন পুরুষ। শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে ঢাকা স্ট্রম-এ কাজ করা উর্মি শর্মা আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগক করা ৭ জন নারীর একজন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর ৭ দিন আগে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, চাকরির আর পরিবেশ নেই, যে কোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে, সে ভয়ঙ্কর মানষিক যন্ত্রণায় আছে। এখন সেই যন্ত্রণা থেকে, নাকি অন্য কোনো কারণে স্বর্ণময়ী আত্মহত্যা করেছে সেটা তো বলা মুশকিল।”
আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর অফিসের পরিস্থিতি কেমন ছিল- এমন এক প্রশ্নের জবাবে উর্মি বলেন, “আমরা একেবারেই নিরুপায় হয়ে অভিযোগ করেছিলাম। কারণ, আলতাফ শাহনেওয়াজের আচরণ আমরা আর নিতে পারছিলাম না। সবার সঙ্গেই তিনি খারাপ আচরণ শুরু কলেছিলেন। তার চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই ছিল একজন নারীর জন্য অস্বস্তিকর। অভিযোগ দেওয়ার পর সম্পাদক আমাদের সঙ্গে একবারও কথা বলেননি। তাকে (আলতাফ শাহনেওয়াজ) নিউজরুম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সত্যি, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তাকে আরও বেশি ক্ষমতা দিয়ে অফিসে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে তার আচরণ ছিল আরো বেপরোয়া। পরেও তিনি নানা বিষয়ে আমাদের ডেকে কথা বলতেন- যেটা হওয়ার কথা ছিল না।”
উর্মি শর্মা মনে করেন, তাকে চাকরিচ্যুত করার পেছনেও ভূমিকা রেখেছে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “ কিছুদিন আগে একজন পুরুষ সহকর্মীকে সম্পূর্ণ বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম। আর এইচআর থেকে আমাকে ডেকে বলা হয়েছে, আমি নাকি নিউজ দিতে তিন ঘণ্টা দেরি করি। অথচ নিউজ দেওয়ার কোনো টাইম আমাদের অফিসে নির্ধারিত নেই। ফলে এটি একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। আমার মনে হয়েছে, আমরা অভিযোগ দেওয়ার পর আলতাফ শাহনেওয়াজকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছে সম্পাদক নিজেই। আরও বেশি ক্ষমতাবান করা হয়েছে। স্বর্ণময়ীর মৃত্যু না হলে হয়ত আমরা যারা অভিযোগ করেছিলাম তাদের সবাইকেই চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হতো। চাকরি চলে যাওয়ার কারণে আমি গত ৯ অক্টোবর থেকে আর অফিসে যাইনি। তবে স্বর্ণময়ী তো সরাসরি আলতাফ শাহনেওয়াজের অধীনে কাজ করতেন না। কিন্তু তারপরও স্বর্ণময়ীকে তিনি বারবার চাকরিচ্যুতির ভয় দেখাতেন। স্বর্ণময়ী ছিল একটু অন্তর্মুখী টাইপের মেয়ে। ফলে আলতাফ শাহনেওয়াজের এই আচরণ সে মেনে নিতে পারেনি।”
গণমাধ্যমে যৌন হয়রানির কিছু অভিযোগ এবং বিচারহীনতা
যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন। এর আঁচ লাগে বাংলাদেশেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন কয়েকজন। শুচিস্মিতা সীমন্তী হ্যাশট্যাগ মি-টু লিখে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ফেসবুকে প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, “আমার বয়স যখন ১৬, তখন আমাকে যৌন নিপীড়ন করেন সাংবাদিক প্রণব সাহা। আমার শরীরে বহুবার আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে সবার অগোচরে এই বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম এবং এই ঘটনা আমার হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল।” শুচিস্মিতা সীমন্তী সাংবাদিক সুপ্রীতি ধরের মেয়ে।
সেই সময় শুচিস্মিতা সীমন্তী বিদেশে থেকে টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, “প্রণব সাহা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড ছিলেন। উনি অনেক সময় আসতেন। আমি যখন পড়তাম, আমার রুমে আসতেন এবং উনি যেভাবে টাচ করতেন এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অনেকবার এ ঘটনা হয়েছে আমার সাথে। এতবার হয়েছে যে, আমি হিসাবই করতে পারবো না। চেষ্টা করেছি যাতে এক্সট্রিম কোনো পর্যায়ে না যায়।”
তখন ফেসবুকে সাংবাদিক প্রনব সাহা লিখেছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে সম্প্রতি আমার সাবেক সহকর্মী ও সাবেক প্রেমিকা সুপ্রীতি ধরের মেয়ে শুচিস্মিতা সীমন্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ১১ বছর আগে তার ১৬ বছর বয়সে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছে। যদিও ২০০৪ সালের দিকে কয়েক বছর প্রেমের সম্পর্কের সময় সুপ্রীতির ছেলে-মেয়ে সীমন্তি ও সৌম্যকে নিজের সন্তানের মতোই দেখেছি। তারাও নিশ্চিন্তে প্রণব মামার কোলে-পিঠেই বড় হয়েছে। পরিষ্কার করে বলতে চাই, সন্তানতুল্য সীমন্তি যে এক যুগ পরে এমন একটা অভিযোগ তুলতে পারে, সেটাই আমার জন্য বড় পীড়াদায়ক। এ অভিযোগের যেমন কোনো ভিত্তি নাই, তেমনি এটাকে ধরে আমাকে সামাজিক, মানসিক এবং পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করাও সমীচীন নয়। আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও গ্রহণযোগ্য নয়।”
ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের তৎকালীন কূটনৈতিক প্রতিবেদক রেজাউল করিম লোটাসের বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ মি টু-তে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিলেন তারই এক সময়ের সহকর্মী সাংবাদিক আলফা আরজু। বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী আলফা আরজু তখন আলফা আরজু ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, “একই সিএনজিতে করে বাসায় ফেরার সময় রেজাউল করিম লোটাস কয়েকবার বাজেভাবে স্পর্শ করেছে। চাকরির ভয়ে তখন কিছু বলিনি।” এমন অভিযোগ ওঠার পর ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত চলাকালেই ডেইলি স্টারের চাকরি ছাড়েন লোটাস। বর্তমানে তিনি অন্য একটি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক নারী সহকর্মীর করা যৌন হয়রানির অভিযোগে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)-র তৎকালীন প্রধান প্রতিবেদক এমএম সেকান্দারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তখন কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, সেকান্দারের বিরুদ্ধে এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই ভোরে তাকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনার তদন্তও বেশিদূর এগোয়নি।
‘নারীরা অভিযোগ করতে ভয় পান’
বর্তমানে সংবাদমাধ্যমে নারীরা কী পরিবেশে কাজ করেন জানতে চাইলে একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি শাহনাজ শারমীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এক্ষেত্রে আগে দেখতে হবে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন, সেটা কয়টা গণমাধ্যম বাস্তবায়ন করেছে৷ হাইকোর্ট সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করার কথা বলেছিল। কমিটি কেমন হবে সেটাও বলেছিল। কিন্তু দুঃজনক হলো, ৩০টি টেলিভিশনের মধ্যে মাত্র তিনটি টেলিভিশনে এই কমিটি আছে, অন্যগুলোতে নেই। অর্থাৎ, হাইকোর্টের এই আদেশ বাস্তবায়িত হয়নি।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি এমআরডিআইতে গণমাধ্যমের নারী কর্মীদের কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করি। সেখানে অনেক নারী সংবাদকর্মী আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু তারা অভিযোগ সামনে আনতে ভয় পান, কারণ, যদি চাকরি চলে যায়?”
দৈনিক দেশ রুপান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার তাপসী রাবেয়া আখি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সামনে যে অভিযোগগুলো আসে, সেগুলো মোট ঘটনার ২০ ভাগও না। এখনও গণমাধ্যমে নারীদের কর্ম পরিবেশ মসৃণ হয়নি। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আপনি যার কাছে অভিযোগ করবেন তিনিও পুরুষ। ফলে ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এই ভয়ে নারী কর্মীরা অভিযোগ করতে সাহস করেন না। কিছু ঘটনার বিচার হলে নারী কর্মীদের কর্মপরিবেশ ভালো হতো।’’
ডিডাব্লিউ ডটকম
সমীর কুমার দে, ঢাকা 


















